আবু তাহের বাপ্পা
Published:2024-11-19 12:07:00 BdST
তারেক রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ব্যবসায়ীরাচাদাঁবাজি বন্ধে উদ্যোগ গ্রহনের দাবী
মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানা বিএনপির এক নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ এসেছে। জানা গেছে, হাইব্রিড এই নেতা বিএনপি’র সদস্য সচিব অপু চাকলাদার নামে পরিচিত। তিনি চাদাঁবাজি এবং দখল বাণিজ্য সহ সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে স্থানীয় সূত্রে খবর জানা গেছে।
সরেজমিনে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণঅভূত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশের সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। কিন্তু মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানা এলাকা একেবারে ভিন্ন চিত্র। গণঅভ্যুত্থানের আগে অপু চাকলাদারের আপন ভাই মাফিয়া খ্যাত মিজানুর রহমান দিপু চাকলাদার ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পুরো সময় জুড়ে এলাকায় চাদাঁবজিসহ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেছেন।
চাঁদাবাজি, সুদ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও জমি দখলবাজিসহ এমন কোন অপকর্ম নেই যে দীপু চাকলাদার করেননি। ক্ষমতার দাপটে অপকর্মের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। অবৈধ উপায়ে আয়ের অংশ টাকা বিদেশে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে দীপু চাকলাদারের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী সরকারের পতনের পর লৌহজং-এ দীপু চাকলাদারের পারিবারিক রাজত্ব কমেনি। শুধুমাত্র হাত বদল হয়ে সব ক্ষমতার দন্ডমুন্ডে পরিনত হয়েছে দিপুর ভাই অপু চাকলাদার। আওয়ামী দুঃশাসন আমলে নিয়ন্ত্রণ করেছেন মিজানুর রহমান দীপু চাকলাদার। এখন ভাইয়ের সকল অপরাধ রাজ্য রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন বিএনপি নেতা অপু চাকলাদার। দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে স্থানীয় তালতলা ডহুরি খালে নির্ধারিত চাদাঁর বিনিময়ে চলছে অবৈধ বাল্ক হেড। দখলবাজদের অতিতের সব আমলনামা জেনেও নীরবতা পালন করছে স্থানীয় প্রশাসন।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে বিগত সময়ে মিজানুর রহমান দীপু যে সব লোকের মাধ্যমে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন এখন ওই লোকগুলোই পেছনে থেকে বিএনপি পন্থীদের সামনে এনেছে । আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি মিলে মিশেই গড়ে তুলেছে সিন্ডিকেট।
জানা গেছে, অপু চাকলাদারের নেতৃত্বে যারা চাদাঁবাজি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে তার হচ্ছে বুলবুল, রফিক, বুলু, লিটু, লাট্টু চাকলাদার। এরা সবাই বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার কথা বলে। চাদাঁবাজির মিশ্র সিন্ডিকেটে অন্যরা হচ্ছে বালিগাঁওয়ের রাজন মুন্সি ও সজন মুন্সি, ডহরি খালের মুখ রিপন, ওসমান, রুবেল, আনোয়ার ও রাজিব খান। উক্ত সিন্ডিকেটের সদস্যরা বালিগাঁও থেকে ডহরির পদ্মা নদীর মুখ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে প্রত্যেক খালি বাল্কহেড থেকে নিচ্ছেন ১৫শ টাকা। আর ডহরি খালের মুখ থেকে বালিগাঁও পর্যন্ত বালুভর্তি বাল্কহেড পারাপার করে দিচ্ছেন তিন হাজার টাকা চাঁদা নিয়ে।
বাল্কহেড সংশ্লিষ্টরা জানান, পদ্মা থেকে বালু নিয়ে রাজধানী ঢাকা এবং আশপাশে যাওয়ার সহজ পথ হচ্ছে তালতলা-গৌরগঞ্জ (ডহরি) খাল। এখানে প্রশাসনিকভাবে বাল্কহেড চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও চাদাঁর বিনিময়ে এটা চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
স্থানীয় বিএনপি নেতাদের মতে, দখল বাজি ও চাদাঁবাজিতে অপু চাকলদারের সংশ্লিষ্টতা সামনে আসায় স্থানীয় বিএনপি’র ত্যাগী নেতাকর্মিদের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বিএনপি নেতা জানান, লৌহজংয়ে চলছে একটি বিশেষ পরিবারের রাজত্ব। এরা নিজেদের স্বার্থে আওয়ামীলীগ আমলের সব মাফিয়াদের রক্ষা করে চলেছে। কারণ আওয়ামীলীগের সময় বেপরোয়া হয়ে ওঠা আওয়ামীলীগ নেতা রশিদ সিকদার, আশরাফ চেয়ারম্যান, সেলিম মোড়লসহ অধিকাংশ নেতারাই অপু চাকলাদারের পারিবারিক আত্নীয় ও পরমবন্ধু। এসকল আওয়ামীলীগ মাফিয়াদের ব্যবসা সহ অবৈধ সকল কাজকে রক্ষার সিপাহসালারের দায়িত্ব পালন করছে এখন বিএনপি নেতা অপু চাকলাদার। বিএনপির হাই কমান্ড থেকে বার বার দখল, চাদাঁবাজিসহ কোন প্রকার সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির মতো কাজে নেতাকর্মিদের জড়িত না হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হলেও সেদিকে কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ নেই অপু চাকলাদারের। এতে স্থানীয় পর্যায়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে বিএনপির জনপ্রিয়তা।
এ বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নেতৃবৃন্দ বলেন, কারো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সমরাজ্য রক্ষার গার্ড পয়েন্ট হবে না বিএনপি। যদি এমন হয় তাহলে কারো প্রতি দল দয়া দেখাবে এমন ভাবার সুযোগ নেই। বিষয়টি সত্য হলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পর্যন্ত জানানো হবে। অপর একটি সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া, লৌহজং ও সিরাজদিখান থানার বেশ কিছু বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনের শক্ত অবস্থানের কারণে গত ২ বছর বাল্কহেড চলাচল বন্ধছিলো। এ কারণে খালের পাড়ও ভাঙেনি। এ বছর আবার বাল্কহেড চলাচল শুরু হওয়ায় ভাঙন শুরু হয়েছে। এভাবে বাল্কহেড চলতে থাকলে পদ্মার ভাঙনে খালের দু’পাশের জনপদও বিলীন হয়ে যাবে । আতঙ্ক বিরাজ করছে ডহুরি খালের দু’তীর জুড়ে বাসিন্দাদের মধ্যে । অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধূ লৌহজং নয়, রাজধানীর ইসলামপুরে রয়েছে মিজানুর রহমান দীপু পরিবারের বিশাল সিন্ডিকেট। ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে কাপড় আমদানী করে খোলা বাজারে বিক্রির মাধ্যমে সরকারের শত শতকোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিজেরা হয়েছেন ধনকুবের। আওয়ামী লীগের বিদায়ের পর এখন সে সাম্রাজ্য রক্ষার নেতৃত্বে সামনে চলে এসেছেন দিপু চাকলাদারের ভাই অপু চাকলাদার। এই অনৈতিক এবং অবৈধ কাজে তিনি থানা বিএনপির সদস্য সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদটি ব্যবহার করছেন। এতে বিএনপির ভাবমূর্তি দারুন ভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, শতভাগ রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক (গার্মেন্ট) ও বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজিং কারখানার নামে শুল্কমুক্ত বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধায় আমদানি করা পণ্য চোরাই পথে বিক্রি করে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন বিএনপি নেতা অপু চাকলাদার ও তার ভাই আওয়ামী মাফিয়া খ্যাত দীপু চাকলাদার। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর সমন্বয়ে বিভিন্ন ধরনের কাপড় ও কাগজ খোলাবাজারে ছেড়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে দিপু-অপু। ৫ আগষ্টের পর দীপু চাকলাদার পলাতক। সাম্রাজ্য রক্ষায় বিএনপি’র রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করছেন অপু চাকলাদার।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও কয়েকটি স্থলবন্দর থেকে ইসলামপুর ও নয়াবাজার পর্যন্ত গড়ে ওঠা এই চোরাই পণ্যের কারবারিদের সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন লৌহজং থানা বিএনপির সদস্য সচিব অপু চাকলাদার। রাজস্ব বিভাগের বন্ড কমিশনারেট এবং শুল্ক গোয়েন্দাদের পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এই তথ্য।
অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া চাহিদা তৈরি করে বন্ড সুবিধায় কাপড় ও কাগজ এনে চোরাকারবার চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ওয়াকিবহাল সূত্রমতে, ২০১৭ সালের ২০ আগষ্ট পুরান ঢাকার গুলশান আরা সিটি মার্কেটের সামনে কাভার্ড ভ্যান থেকে বিপুল পরিমাণ চোরাই পণ্য উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় মাসটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সৈয়দ আবিদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান ও খন্দকার সুরাত আলীর বিরুদ্ধে মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। মামলাটির তদন্ত করে সিআইডি। তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে শতকোটি টাকার বেশি শুল্ক ফাঁকির তথ্য মেলে।
এর আগে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের মাসুদ প্যাকেজিং, মেসার্স ইসলাম অ্যাসোসিয়েটসসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভুয়া নথি তৈরি করে ডুপ্লেক্স বোর্ড কাগজ আমদানি করে চোরাকারবারির অভিযোগে মামলা করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। আদমজী ইপিজেডকেন্দ্রিক মেসার্স আঙ্কেল প্যাকেজিং লিমিটেড নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগে মামলা করা হয়। এসব মামলায় ব্যাংকের সঙ্গে আঁতাত করে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের সঙ্গে নিয়ে ভুয়া প্রতিষ্ঠান বন্ড জালিয়াতির তথ্য পায় সিআইডি। চট্টগ্রামের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মিজানুর রহমান দীপু চাকলাদার ও হাবিবুর রহমান অপু চাকলাদার নামের দুই সহোদরের শুল্ক ফাঁকি ও চোরাকারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ পেয়ে তদন্তে নামে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। ওই সময় দীপুকে গ্রেফতার করেন শুল্ক গোয়েন্দা। পরে মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করা হয়। অপুর মালিকানাধীন মেসার্স চাকলাদার সার্ভিস এবং দীপুর মালিকানাধীন এমআর ট্রেডিংয়ের সঙ্গে কাস্টমস কমিশনারদের সখ্য ছিল। তাঁরা যেসব আমদানিকারকের নামে পণ্য আমদানি করেন তার বেশির ভাগই ভুয়া।
ঐ মামলায় দীপু ছাড়াও চারজনকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তাঁরা হলেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মী সোহরাব হোসেন ওরফে রিপন, ডেসপাচ শাখার কর্মচারী সিরাজুল ইসলাম, এআইআর শাখার উচ্চমান সহকারী মাসুম ও মফিজুল ইসলাম লিটন নামের এক আমদানিকারক। মফিজুল ইসলাম লিটন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তিনি অপু-দীপুর চোরাকারবার ও শুল্ক ফাঁকি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আওয়ামীলীগের মাফিয়া খ্যাত দীপু চাকলাদার এখন অত্মগোপনে আছেন। অপু চাকলাদার ভাইয়ের অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন। বিএনপি দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে বিশেষ সুবিধা নিচ্ছে অপু চাকলাদার।
এ ব্যাপারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ইসলামপুরের আদি ব্যবসায়ীরা। একই সাথে অপু চাকলাদারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ গুলো তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মহল।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.