নেহাল আহমেদ, রাজবাড়ী
Published:2025-01-04 18:42:58 BdST
সাগর সেন স্মরণে
রাজবাড়ী জেলার প্রখ্যাত জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন বিজনবিহারী সেন ও নয়নমঞ্জরী সেনের কনিষ্ঠ পুত্র সাগর সেন। শৈশবকাল বাংলাদেশে কাটলেও তাঁর প্রায় আড়াই দশকের সঙ্গীতজীবন কেটেছে কলকাতাতেই।
রাজবাড়ী সদর উপজেলায় বানীবহ একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম। বানীবহ কে বলা হয়ে থাকে স্বরসতীর গ্রাম। বানীবহ গ্রামেই সেই সময়ে বসবাস করতো সাতশ ঘর রাঢ়ী ব্রাক্ষণ। ছিলো সরকারী-বেসরকারী গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন অনেক শিক্ষিত মানুষ।
এই গ্রামে অনন্ত সাতটি জমিদারের সন্ধ্যান পাওয়া যায়। তার মধ্যে রায় বাহাদুর কামিনী কুমার রায় ছিলেন সাত আনার জমিদার। কামিনী কুমার জমিদারের পরবর্তী বংশ ছিলেন বিপিন বিহারী মুন্সি। বিপিন বিহারী মুন্সির সন্তান ছিলেন বিজন বিহারী সেন। আজ আমরা যাকে সাগর সেন হিসাবে চিনি তিনিই হচ্ছেন বিজন বিহারীর সন্তান।
সাগর সেন শুধুমাত্র একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রতিভাই নন, তিনি ছিলেন একাধারে সঙ্গীত পরামর্শদাতা, আয়োজক, সঙ্গীত পরিচালক এবং সর্বোপরি একজন মানবদরদী মানুষ। নিজের আয়োজিত বহু চ্যারিটেবেল পাবলিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি অক্লান্তভাবে জনহিতকর কাজের প্রেক্ষিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। বিশেষ করে সত্তরের দশকের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য মুখ্যমন্ত্রী ত্রাণ তহবিলে তিনি বিপুল পরিমাণ আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। কত মানুষকে নিঃশব্দে কত দান করেছেন তিনি, পরিবারের কাউকে কখনও তা জানতে দেননি। তাঁর বহু ছাত্র ও অসংখ্য অনুরাগীদের কাছে তিনি ছিলেন ঈশ্বরতুল্য মানুষ, একজন পথ-প্রদর্শক, একজন অভিভাবক, একজন পরহিতব্রতী ব্যক্তিত্ব।
১৯৭৪ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইণ্ডিয়ার ব্যানারে আসে তাঁর প্রথম লং প্লে রেকর্ড ‘পূজা ও প্রেম’ রেকর্ডের দুই পিঠে ছিল সাতটি ওকরে মোট চোদ্দটি গান। একপিঠে পূজা পর্বের, আরেকপিঠে প্রেম পর্বের গান। রেকর্ডের ‘আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান’, ‘কতবারো ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া’, ‘অলি বারবার ফিরে যায়’, ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম’ গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। সাগর সেন পরবর্তীতে নিয়মিতভাবে লং প্লে রেকর্ড বের করতে থাকেন। তাঁর হাত ধরে রবীন্দ্রসঙ্গীত ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। বাণিজ্যিক সফলতার দিক থেকেও তিনি পরিণত হন শীর্ষ রবীন্দ্র গায়কে।
১৯৭৪ সালে আধুনিক বাংলা গানেও অভিষেক ঘটে তাঁর। প্লেব্যাক করেন ‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’ ছবিতে। ১৯৭৯ সালে ‘পরিচয়’ ছবিতে গাইলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’। গানটির জন্য বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকে সেরা গায়কের পুরষ্কার পান।
সাগর সেনের সাফল্যের মুকুটে যুক্ত হয় আরেকটি পালক। ১৯৭৫ এর আগস্টে কোলকাতা দূরদর্শনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশনার সম্মান পান তিনি। সাথে ছিলেন আরেক বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুমিত্রা সেন। সাগর সেন পরিবেশন করেছিলেন ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’।
সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন সাগর সেন। ‘রবি রাশমি’ নামে সঙ্গীত বিদ্যালয় গড়ে তোলেন তিনি। অংশ নেন বিখ্যাত কিছু কনসার্টে। এর মধ্যে ছিল- শ্রাবণ সন্ধ্যা, শাপমোচন, ঋতুরঙ্গ, গানের ঝরণাতলায়, বিশ্বজন মোহিছে, স্বদেশে নেয়ে বিদেশে খেয়ে (পাশ্চাত্যসুরের রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে আয়োজন) ইত্যাদি৷ পারফর্ম করেন রবীন্দ্র সদন, শিশির মঞ্চ, কলা মন্দির এর মত জায়গায়।
তিনি ষাট দশকের শুরুর দিকে রবীন্দ্রসংগীত জগতে পদার্পণ করেন, যখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস ও চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের মতো মহারথীরা জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র সঙ্গে তার প্রথম রেকর্ড সম্পন্ন হয় ১৯৫৮ সালে। তারপরই তিনি কলকাতার আকাশবাণীতে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসেবে পরিবেশনা শুরু করেন।
সন্তোষ সেনগুপ্তের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাপমোচন (১৯৬৬) ও বাল্মিকী (১৯৬৭)এই অপেরা দুটির রেকর্ডিংয়ে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মায়ার খেলা’ অপেরার ‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান’ এ গানটি সাগর সেনকে রবীন্দ্রসংগীত জগতে গুরুত্বপূর্ণশিল্পী হিসেবে পরিচিতি দান করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
সত্তর দশক ও আশি দশকের শুরুর দিকে তিনি গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়া লিমিটেডের সঙ্গে প্রচুর গান রেকর্ড করেন। ১৯৭৪ সালে তার প্রথম লংপ্লে রেকর্ড প্রকাশ পায়, যেখানে পূজা ও প্রেম পর্বের সাতটি করে ১৪টি রবীন্দ্রসংগীত স্থান লাভ করে। ‘আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান’ ছাড়াও তার গাওয়া জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত গুলোর মধ্যে ‘বঁধূ মিছে রাগ করো না’, ‘জীবনে আমার যত আনন্দ’, ‘আমায় থাকতে দে না আপন মনে’ এবং ‘তোমার গোপন কথাটি সখী রেখো না মনে’ অন্যতম।
তিনি কলকাতায় ‘রবি রশ্মি’ নামে একটি সংগীত প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন ও এ প্রতিষ্ঠানটি কলকাতায় জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাগর সেন কিছু আধুনিক বাংলা গানেও কণ্ঠ দেন। যে যেখানে দাঁড়িয়ে (১৯৭৪) ও পরিচয়ের (১৯৭৯) মতো আবির্ভাব ও মন্ত্রমুগ্ধ সিনেমার গানেও তিনি কণ্ঠ দেন। তিনি ১৯৭৯ সালে পরিচয় সিনেমায় ‘আজ জোৎস্নারাতে সবাই
গেছে বনে’ গানটি গেয়ে বিএফজে পুরস্কার লাভ করেন।
সাগর সেনের তিন পুত্র প্রিয়াম সেন, প্রিতম সেন ও প্রমিত সেন। এদের মধ্যে প্রমিত সেন প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। ক্যারিয়ারে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা নিয়ে এগিয়ে চলছেন সাগর সেন। হঠাৎ এলো সেই দুঃসংবাদ। এই কণ্ঠের জাদুকরের গলায় বাসা বেঁধেছে মরণঘাতী ক্যান্সার। ১৯৮১ সালের কথা সেটি। চিকিৎসা শুরু হলো। কিন্তু বিশেষ কিছু সুবিধা হলো না। এরকম সময়েও তিনি গান গাওয়া ও শেখানো অব্যাহত রাখেন। অবশেষে ১৯৮৩ সালের ৪ ঠা জানুয়ারি মাত্র ৫০ বছর বয়সে পরলোকে পাড়ি জমান এই স্বর্ণকণ্ঠ গায়ক।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.