মানসুরা চৌধুরী দোলা
Published:2025-01-27 18:32:09 BdST
দুদককে পাত্তাই দেয় না রাজউকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারাদুদক ও রাজউক কর্মকর্তাদের সাপ-লুডু খেলা
দুর্নীতি, অনিয়ম ও দুর্নীতিবাজ এই তিন শব্দের মহামিলন যেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।দুর্নীতির এমন কোন শাখা প্রশাখা নাই যার ছোঁয়া পড়েনি রাজউকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাঝে। রাজকীয় চাকুরী মানেই রাজউক। হোক সে অফিস সহকারী, কম্পিউটার অপারেটর, চেইনম্যান, নকশাকার, পিয়ন, স্টোর ইনচার্জ, পরিদর্শক, অথরাইজড অফিসার, পরিচালক, সদস্য থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান পর্যন্ত।
রাজউকের প্রতিটি ইট, পাথর ঘুষ খায় ও দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত । রাজউক নিয়ে গণমাধ্যমের এত কথা, এত লেখালেখি তবু কিছুতেই কিছু হয় না। সাধারণ জনগণের একটাই কথা- দুদকের কর্মকর্তারাও রাজউকের কর্মকর্তাদের ভয় পায়। বিষয়টি হাস্যরসের হলেও বাস্তবে এর অনেক মিল পাওয়া যায়।
“দ্য ইনভেস্টরের” অনুসন্ধান
রাজউকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কেন আইনের আওতায় নিতে পারে না দুর্নীতি দমন কমিশন? শত শত অভিযোগ জমা পড়লেও কেন দৃশ্যমান বিচার হয় না রাজউক কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের? কেন তাদের এত আস্ফালন?
সমাধান একটাই। দুদকের ক্ষমতাধর কর্মকর্তাদের অধিকাংশেরই রয়েছে রাজউক এরিয়ার মধ্যে প্লট/ বাড়ি ও সম্পদ। দুদকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব রয়েছে রাজউক কর্মকর্তাদের হাতে। দুদকের রাঘব বোয়াল কর্মকর্তারা নামে বেনামে স্ত্রী, সন্তানদের নামে যে অবৈধ সম্পদ করেছে তা রাজউকের অজানা নয়। অতএব রাজউকের কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের দাম্ভিকতা 'দুদকের মাধ্যমে আমাদের কিছুই হবে না'।
রাজউকের একেকজন কর্মচারী কখনও নেতা, কখনও পাতিনেতা বা চাটুকার হয়ে শত শত কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। কিন্তু এত অভিযোগের পরেও তা দুদকের অনুসন্ধানে আলোর মুখ দেখে না। মাঝে মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন ঢাক ঢোল পিটিয়ে রাজউকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণী চেয়ে নোটিশ প্রদান করে। কিন্তু ওই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ দুদকের আস্ফালন। দীর্ঘদিন চলে চিঠি চলাচালি। মাঝে মধ্যে গণমাধ্যমে ট্রল হয়। কিন্তু চূড়ান্ত অনুসন্ধান হয় না। বিগত পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে রাজউক কর্মচারী ইউনিয়নের ক্ষমতাধর কর্মচারীগণ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছে কিন্তু দুদকের নিশানায় তেমন কেউ আসেনি।
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানসহ এই তালিকায় রয়েছে অসংখ্য রাঘব বোয়াল। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন এখনো তাদের কাউকেই আদালতের নিকট সোপর্দ করতে পারে নাই। অথচ ৫ই আগস্ট পট পরিবর্তনের পর মাত্র ৪/৫ মাসেই বহু রাজনৈতিক নেতার দুর্নীতি তদন্ত করে চার্জশিট প্রদান করেছে, এটা কিভাবে সম্ভব হলো?
তাহলে আবারও বলতে হয় যে দুদক এখনো রাজনৈতিক বিবেচনা তদন্ত করছে? দীর্ঘদিন যাবত রাজউকের একদল ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীর সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়, কিন্ত সংবাদ প্রকাশ হলেও তারা রয়ে গেছে বহাল তবিয়তে।
“দ্য ইনভেস্টরের” দীর্ঘ অনুসন্ধানে শতাধিক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য উঠে এসেছে। এদের মধ্যে অনেকেরই দুদকে অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। আমাদের বিশেষ অনুসন্ধানে উঠে আসা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের তালিকা অনেক। দুই চারজনের ব্যাপারে দুদক মামলা করলেও এখনও তারা রয়েছে বহাল তবিয়তে।
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান এবং চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান মিয়ার বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। হুমায়ুন খাদেম, প্রকৌশলী আজিজুল হক, সাবেক সদস্য লে: কর্নেল এম নুরুল হক, সাবেক পরিচালক মোঃ রহমান ভুইঁয়া,
রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ -২) মো: মোবারক হোসেন ও তার স্ত্রী শাহানা পারভীন এবং সহকারী প্রকৌশলী, মো.আব্দুল করিমের নামে মামলা হলেও তারা সবাই আছেন বহাল তবিয়তে।
রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিকের বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক অভিযোগ। তিনি নতুন শহর প্রকল্পের পিডি ছিলেন। এই সুযোগে বাগিয়ে নিয়েছেন প্লট। এছাড়াও জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন ১০ কোটি টাকা।
রাজউকের প্রশাসন শাখার নথি সংরক্ষক হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনুমানিক ২০০ ফাইল নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বেপরোয়া অফিস সহায়ক জাফর সাদেক ও নকশাকার এমদাদ আলী বর্তমানে নারায়ণগঞ্জে কর্মরত। ইমারত পরিদর্শক মনিরুজ্জামান, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নাসির উদ্দিন চৌধুরী, সহকারী অথরাইজড অফিসার আওরঙ্গজেব সিদ্দিকী বাবু, সার্ভেয়ার মাসুম বিল্লাহ, সুপারভাইজার খালেদ মোশাররফ তালুকদার রুবেল, বেঞ্চ সহকারী বাশার শরিফ, নিম্নমান সহকারী ইউসুফ মিয়া, এমআইএস শাখার অফিস সহকারী বেলাল হোসেন চৌধুরী রিপন, নকশাকার শহীদুল্লাহ বাবু, কনিষ্ঠ সহকারী মোঃ হাসান, নকশাকার শেখ ফরিদ, রেকর্ড কিপার মোঃ ফিরোজ, প্রকৌশলী কাইছার,পরিচালক মোঃ মোবারক হোসেন, এ কে এম বায়েজিত খান, বেলাল হোসেন চৌধুরী, উচ্চমান সহকারী মোঃ হাসান খান, রেখাকার মোহাম্মদ শফিউল্লাহ বাবু, আওরঙ্গজেব নান্নু, গোল্ডেন মনির, দেবাশীষ কুমার সাহা, কেরানী জাহিদুল ইসলাম,কালা জাহাঙ্গীর, গুলশান স্টারিং সহকারী রেবেকা, নকশা শাখার অফিস সহকারী আব্দুল কাইয়ুম, অফিস সহকারী হিটলার জাহাঙ্গীর আলম, কেরানী দম্পতি আনোয়ার হোসেন আলম এবং তার স্ত্রী কম্পিউটার অপারেটর ফারহানা, জোন ১ এর পরিচালক হাফিজুর রহমান, রাজউকের জোন ৫ এর উচ্চমান সহকারী ফাতেমা বেগম, জোন ৪ এর হিসাব রক্ষক মোফাজ্জল হোসেন ওরফে বিদ্যুৎ, জোন ৩ এর নিম্নমান সহকারী মহিউদ্দিন ওরফে মাস্টার মহিউদ্দিন, রাজউকের পাম্প চালক নজরুল ইসলাম ওরফে ধামরাই, কেরানী মোশাররফ হোসেন ওরফে স্কাই, পূর্বাচল প্রকল্পের কম্পিউটার অপারেটর গিয়াস উদ্দিন ওরফে পাঠান, শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রাজউকের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর নাসির উদ্দিন চৌধুরী, ইউসুফ মিয়া, সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ এবং তার স্ত্রী মেরিনা, এবং জাহিদুল ইসলাম সবুজ।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে পরিচালক মোবারক হোসেন, সহকারী প্রকৌশলী মো.আব্দুল করিম, এ কে এম বায়েজিদ খান, উচ্চমান সহকারী মোঃ হাসান, শফিউল্লাহ বাবু, আওরঙ্গজেব নান্নু,দেবাশীষ কুমার সাহা, কেরানী জাহিদুল ইসলাম, কালা জাহাঙ্গীর, গুলশান এস্টেট শাখার ডিলিং সহকারী রেবেকা, সহ আরো অনেকে।
এখানেই শেষ নয়, অধিকাংশ পরিদর্শক ও অথরাইজড অফিসার দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড। দুর্নীতি দমন কমিশনের উদ্যোগই পারে এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আইনের আওতায় আনতে।
“দ্য ইনভেস্টর” এর ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজ একজন নকশাকারের অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে।
নকশাকার এমদাদ আলী কোটি কোটি টাকার মালিক। মেরুল বাড্ডার রাজউক প্রকল্পে তার রয়েছে ৬ তলা বিশিষ্ট কয়েক কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি।
চাঁদপুর জেলার মতলবের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়ি এমদাদের। ১৯৯৮ সালে দৈনিক হাজিরার ভিত্তিতে রাজউকে আসা যাওয়া শুরু হয় তার। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই গুঞ্জন উঠে, ঘুষ নামক সাগরে তলিয়ে যাওয়ার ফলেই চাকুরী হারায় এমদাদ। চাকুরী ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠে সে। ২০০৯ সালে চাকুরী ফিরে পাওয়ার জন্য মামলা করেন এমদাদ। পরবর্তীতে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১৩ সালের দিকে চুক্তিভিত্তিক চাকুরী ফিরে পান তিনি। কয়েক বছর পর ২০১৭ সালের দিকে নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করে স্থায়ী হওয়ার সাথে সাথেই নিজের পূর্ববর্তী রুপে ফিরে যান তিনি। অন্যায়ের সাথে আপোষ করে হয়ে যান দূর্নীতির সম্রাট।
রেখাকার হিসেবে চাকুরীতে যোগদান করলেও তার পদোন্নতি হয় নকশাকার হিসেবে। মাত্র ২৪ হাজার টাকা বেতনে চাকুরী করতেন তিনি। সামান্য আয়ে বনে যান কোটিপতি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তার ৬ তলা বাড়ির প্রধান ফটকে সাদা পাথরে খোদাই করে লেখা চাঁদপুর হাউস, বাড়ি নং: ৫৩, রোড নং-১৩, দক্ষিণ বারিধারা ডিআইটি প্রজেক্ট, মেরুল বাড্ডা, ঢাকা ১২১২।
এই এলাকার অনেকেই জানেন তিনি একজন বড় প্রকৌশলী। শুধু এই বাড়িই নয়, তার রয়েছে সাবেক এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লার ডেমরার বাড়ির সামনে আরো দুটি সাত কাঠার প্লট। মাসিক মাত্র ২৪ হাজার টাকা বেতনে কি সত্যিই এই রাজকীয় আয়েশী জীবন যাপন সম্ভব তা নিয়ে বিস্মিত অনেকেই।
রাজউকে এমন অনেকেই আছেন যারা সংবাদকর্মীদের বলে থাকেন, আপনারা তো নিউজের পর নিউজ করেই যান, কই তাদের তো কিছুই করতে পারেন না। এত অপকর্ম করার পরও এমদাদের মতো অসাধুরা থেকে যায় বহাল তবিয়তে। দুদকের নিশানায় তারা থাকলেও শুধুই যুক্ত হয় বদলি নামক শব্দটি।
বর্তমানে এমদাদ আছেন নারায়ণগঞ্জের জোনাল অফিসে। তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এই প্রতিবেদক। তার অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায় নি। শুধু তাই নয়, তার সাথে রিপোর্টার পরিচয়ে ফোনে যোগাযোগ করলে উক্ত রিপোর্টারের পরিচয় পেয়ে ফোন কেটে দেন এমদাদ। এক রকম বেপরোয়া জীবনযাপণ করেও তিনি কিভাবে বহাল তবিয়তে রয়েছে সেটাই খতিয়ে দেখার বিষয়।
তাদের এই বহাল তবিয়তে থাকার পিছনের গল্পটি অজানাই থেকে যায় সকলের কাছে। তাদের মতো দূর্নীতিগ্রস্থদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েই জন্ম হয় হাজার হাজার এমদাদের।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.