সুরাইয়া মাহমুদা মিষ্টি
Published:2025-02-23 14:56:13 BdST
নার্সিং ও মিডওয়াইফারির উপ-পরিচালক শিরিনা দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড
নার্সিং ও মিডওয়াইফারী অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শিরিনা আক্তারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জানা গেছে। তিনি ঢাকা নার্সিং কলেজে অধ্যক্ষ থাকাকালীন অবস্থায় আর্থিক খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে অধ্যক্ষ হিসেবে ঢাকা নার্সিং কলেজে যোগদান করেন শিরিনা আক্তার।
অভিযোগে জানা যায়, শিরিনা আক্তার এবং সাবেক প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক নুরুল ইসলাম যোগসাজস করে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে নিজেরাই আত্মসাৎ করেছেন। তবে কত টাকা আত্মসাৎ করেছেন তার কোন নির্দিষ্ট হিসাব জানা যায়নি। শিরিনা আক্তার ও নুরুল ইসলাম অফিসের কর্মকর্তা ও ছাত্রছাত্রীদের সাথে খুবই র্দুব্যবহার করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতিত সরকারের পক্ষে নগদ টাকা খরচ করেছেন বলেও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। তাদের নোংড়া ব্যবহারে ছাত্রছাত্রীরা অতীষ্ট হয়ে ওঠেন। শিরিনা আক্তার পরধন লোভী এবং স্বার্থপর বলে ছাত্ররা আখ্যা দিয়েছেন।
জানা যায়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্ররা সাবেক অধ্যক্ষ শিরিনা আক্তার এবং প্রধান সহকারী (ক্যাশিয়ার) নুরুল ইসলামের অনিয়ম ও দুর্নীতি বিষয়ে প্রতিবাদ করেন। ছাত্ররা তাদের কাছে হিসেব জানতে চাইলে তারা হিসাব দিতে ব্যর্থ হন। ছাত্রদের তোপের মুখে ২০২৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সাবেক অধ্যক্ষ শিরিনা আক্তার ও প্রধান সহকারী (ক্যাশিয়ার) নুরুল ইসলাম স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন। আরো জানা যায়, তিনি ঢাকা নার্সিং কলেজ ও মিডওয়াইফারি নার্স ঢাকাতে অধ্যক্ষ হিসেবে থাকাকালীন সময়ে বিগত তিন বছরে বি.এস.সি ইন নার্সিং (হিসাব নং-০১০০০১৫৯৯৪২৬১) এর পঁচিশ লাখ বিশ হাজার উনচল্লিশ টাকা, ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারী হিসাব নং-০১০০০১৭৬১৯৪২৬১ এর আট লাখ আটাত্তর হাজার পাঁচশত পাঁচ টাকার আর্থিক অসঙগতি পাওয়া যায়। এছাড়াও ইলেকট্রিক মালামালের মধ্যে সাত টি ল্যাপটপ, দুইটি ডেক্সটপ ও একটি ডিজিটাল ক্যামেরার অসঙ্গতি পাওয়া যায় বলে জানা গেছে। তাদের আর্থিক খাতে অনিম ও দুর্নীতি নিয়ে ঢাকা নার্সিং কলেজ, ঢাকার পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি এখন পর্যন্ত তাদের বিষয়ে কোন তদন্ত রির্পোট জমা দেয়নি কর্তৃপক্ষের নিকট।
ঢাকা নার্সিং কলেজের ৯ম গ্রেডের নার্সিং কর্মকর্তা সাবেক অধ্যক্ষ শিরিনা আক্তার ইউআইডি নং ১৩১০৮১৯৮৬১৫৫৫, সংযুক্তি করে তাকে অধ্যক্ষ হিসাবে নার্সিং মিডওয়াইফারিতে ২০২৪ সালের ১৩ নভেম্বর পদায়ন করা হয়। পরবর্তীতে ২০২৫ সালের এক ডিসেম্বর পদন্নতি দিয়ে উপ-পরিচালক পদমর্যাদা দিয়ে মিডওয়াইফারী অধিদপ্তরে বদলী করা হয়েছে। প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক নুরুল ইসলামকে ২০২৪ সালের ১০ নভেম্বর গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন নার্সিং কলেজে হিসাবরক্ষক হিসেবে বদলী করা হয়েছে।
অভিযোগ প্রকাশ, ঢাকা নার্সিং কলেজ, ঢাকার দায়িত্ব হস্তান্তর সংক্রান্ত পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি কর্তৃক গত ১২ জানুয়ারী দাখিলকৃত প্রতিবেদন অনুযায়ী শিরিনা আক্তারকে ১৬ জানুয়ারী কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন । কিন্তু শিরিনা আক্তার আদৌ কারণ দর্শাণোর নোটিশের কোন প্রকার জবাব প্রদান করেননি। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সদস্যরা হলেন,১. প্রভাষক বিশ্ব জিৎ মজুমদার ২.প্রভাষক শাহেলিয়া ৩. প্রভাষক জান্নাতুন নেছা ৪. প্রভাষক কমলা রানী শীল ৫. প্রভাষক রেহানা খানম।
শিরিনা আক্তারের অনিয়ম, দুর্নীতি ও ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করার পরও এসকল কারণ জেনেও কিভাবে অধ্যক্ষ থেকে উপ-পরিচালক পদে পদোন্নতি পেল এবং এই দূর্নীতর পিছনে কি রহস্য লুকিয়ে আছে তা নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছে সর্বমহলে। শিরিনা আক্তারের খুঁটির জোর কোথায়?
গত ১০ ফেব্রুয়ারী উপ-পরিচালক শিরিনা আক্তারের সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা হলে তিনি বলেন, ছাত্ররা শুধুমাত্র বি.এস.সি ইন নার্সিং (হিসাব নং-০১০০০১৫৯৯৪২৬১) এবং ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারী (হিসাব নং-০১০০০১৭৬১৯৪২৬১) এই দুটি হিসাবের ব্যাংক ষ্টেটমেন্ট বের করেছেন। ১ম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির আরও একটি হিসাবের ব্যাংক ষ্টেটমেন্ট বের করতে পারেননি। ওই হিসাব ০১০০০১৫৯৯০৫০৮ নাম্বারে ১৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা জমা ছিল। তিনি আরো বলেন, সাবেক প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক নুরুল ইসলামের কাছে টাকা জমা নেওয়া ও উঠানোর রসিদ বই ছিলো। ব্যাংকের টাকা জমা হলে আমার মোবাইলে এসএমএস আসতো। তিনি আরো জানান, আমার কাছে এসএমএসে আসা টাকার যে পরিমান ব্যাংকে টাকা জমা হওয়ার কথা ছিল সে পরিমান টাকা ব্যাংকে জমা করেননি। হিসাবের ব্যালেন্সে টাকা কম দেখা গেছে। নুরুল ইসলাম ব্যাংকে টাকা জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। তখন থেকে ক্যাশিয়ার নুরুল ইসলামের মাধ্যমে ব্যাংকে টাকা জমা দেয়া বন্ধ করা হয়। পরে ঢাকা নার্সিং কলেজ এর ক্যাশিয়ার মোঃ মহিদুল ইসলাম কে টাকা জমা দেওয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রথম বর্ষের ভর্তির ১৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকা ব্যাংক হিসাব নাম্বারে জমা করা হয়েছে। এই টাকার হিসাব ছাত্ররা বের করতে পারেনি বলেশিরিন আক্তার মৌখিক ভাবে জানান।
অভিযোগে আরো জানা যায়, ছাত্রদের ভর্তির ফি, মাসিক বেতন, জাতীয় দিবস উদযাপনের টাকা, শিক্ষাবোর্ড থেকে সনদপত্র বাবদ ফি, আইডি কার্ড ইত্যাদি বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের জমাকৃত টাকা শিরিনা আক্তার আত্মসাৎ করেছেন। এ বিষয়েও মন্ত্রণালয়ে তদন্ত চলছে। শিরিন আক্তার বহু কাজের কাজি বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে বা প্রতিবাদ করলে তাকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার ভয় দেখিয়ে থামিয়ে রাখতেন। পতিত সরকারের আমলে তিনি একতছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ছিলেন। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতিত সরকারের পক্ষে নগদ টাকাও খরচ করেছেন শিরিন আক্তার। ওই সময়ে সবাইকে হুমকি-ধামকি দিয়ে রাখতেন।
জানা যায়, নুরুল ইসলামের গ্রামের বাড়ী চাদঁপুর। তিনি ১৯৯২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর চাকুরীতে যোগদান করেন। তার চাকুরীর বয়স বত্রিশ বছর। তিনি পতিত সরকারের দোসর ছিলেন। তাই খুবই দাপটের সাথে চাকরি করছেন। কাউকে তোয়াক্কা করতেন না। শিরিনা আক্তার জয়েন করার পর নুরুল ইসলামের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে । নুরুল ইসলাম ছাত্র-ছাত্রীর ভর্তির ফি ব্যাংকে সঠিক পরিমান টাকা জমা দেয়ার কথা থাকলেও সব টাকা জমা দিতেন না। সেখান থেকে টাকা সরিয়ে ব্যক্তিগত ফান্ডে রাখতেন। নুরুল ইসলামের সাথে শিরিনার ভাল সর্ম্পক হওয়ার পর দু''জন মিলেই টাকা-পয়সা ভাগাভাগি করতেন। এক সময়চ দুজনের মধ্যে সর্ম্পক'র অবনতি হলে নুরুল ইসলামের পরিবর্তে মোঃ মহিদুল ইসলামকে ক্যাশিয়ারের দেয়া হয়। দু’জনেই কলেজের ষ্টাফ, নার্স, ছাত্র-ছাত্রীদেরকে পাত্তা দিতেন না।
নুরুল ইসলাম ২০২২ সালে ছাত্র-ছাত্রীর ভর্তির টাকা আত্মসাৎ করে তার ছেলেকে স্টুডেন্ট ভিসায় আটত্রিশ লাখ টাকা খরচ করে আমেরিকায় পাঠিয়েছেন। এছাড়া তার মেয়েকে উত্তরায় নামিদামি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করাচ্ছেন। তার শশুরবাড়ি ফরিদপুরে জমি কিনে বিশাল বাড়ী করেছেন। একজন প্রধান সহকারী পদে চাকুরী করে এত টাকা তিনি কোথায় পেলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত ১০ ফেব্রুদয়ারী নুরুল ইসলামের সাথে মোবাইলের মাধ্যমে কথা হলে তিনি বলেন, শিরিনা আক্তার ক্যাশ থেকে নুরুল ইসলামের মাধ্যমে এককালীন সতের লাখ তেতাল্লিশ হাজার টাকা লোন বাবদ নিয়েছেন। নুরুল ইসলামের ভাষ্যমতে শিরিন আক্তার ওই টাকা দিয়ে ব্যক্তিগত ফ্ল্যাট কিনেছেন। কিছুদিন পর টাকা ফেরৎ দেয়ার কথা থাকলেও আর ফেরৎ দেননি । এছাড়াও বিভিন্ন সময় নুরুল ইসলামকে চাপ সৃষ্টি করে অনেক বড় অংকের টাকা নিয়েছেন বলে তিনি জানান।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারী নার্সিং ও মিডওয়াইফারী অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শিরিনা আক্তারের সাথে সরাসরি কথা হলে তিনি বলেন, অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে ডিজি অফিস থেকে কারণ দর্শানো যে নোটিশ দিয়েছেন তার জবাব এখন পর্যন্ত দিতে পারিনি। এ বিষয় মন্ত্রণালয়ে তদবীর চলছে। আগামী ২০ মার্চ শিরিন আক্তার এলপিআরএ যাবেন বলে জানান।
নারায়নগঞ্জের বাসিন্দা মোঃ মোতালীব ভূইয়ার মেয়ে শিরিনা আক্তার। শিরিনার স্বামী পুলিশে চাকুরি করতেন। তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। স্বামীর বাড়ী সিরাজগঞ্জ। শিরিনা আক্তার মোহাম্মদপুরস্থ বসিলা চন্দ্রিমা হাউজিং এ ১২০০ স্কয়ার ফিটেরএকটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। বর্তমানে ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে আজিমপুর সরকারী কোয়াটারে দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস করেন শিরিন আক্তার।
এ বিষয় নিয়ে হিসাবরক্ষক মোঃ মহিদুল ইসলাম এ প্রতিবেদক কে জানান,শিরিনা আক্তার এবং নূরুল ইসলাম এখন পর্যন্ত টাকার হিসাব দিতে পারেননি।তিনি আরো জানান টাকা পয়সার বিষয়ে তারা দু’জন মিলেই যুক্তি পরামর্শ করেই যা করার করেছেন।বাইরের কেই এ বিষয় গুলো অবগত নয়।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.