বিশেষ প্রতিবেদক
Published:2025-02-27 20:57:24 BdST
কেওয়াটখালী সেতু প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহনে অনিয়মময়মনসিংহে আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভূমি অধিগ্রহনের ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ
ময়মনসিংহ জেলার ব্রক্ষপুত্র নদীর উপর নির্মিত হতে যাওয়া সর্ববৃহৎ ও দৃষ্টিনন্দন কেওয়াটখালী আর্চ স্টিল সেতুর নির্মাণ প্রকল্পের সংযোগ সড়কের নকশা প্রণয়ন ও ভূমি অধিগ্রহণে প্রকল্প পরিচালকদের অনিয়ম ও দুর্নীতির পর এবার অধিগ্রহণকৃত একটি বিরোধপূর্ণ জমির ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে।
চাঞ্চল্যকর এই ঘটনাটি ঘটেছে ২৬/০২/২০২৫ইং তারিখ (বুধবার) অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এর কার্যালয়ে।
সূত্র মতে, কেওয়াটখালি সেতু প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণের জন্য ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা এলে কেস নং ০৪/২০২২-২৩ এর আওতায় অধিগ্রহণকৃত এই জমির পরিমাণ ৩.৩৯ একর। যার বি আর এস দাগ নং ৭৪৫৮, বি আর এস খতিয়ান নং ৫০৩, ৬৭৬, ১০১৪, ১০৬৯ উপরোক্ত দাগ খতিয়ানে মোঃ সারয়ার হোসেন মন্ডল বনাম রবিনা খাতুনের মধ্যে জমির মালিকানা স্বত্ব ও দখল নিয়ে বিরোধ থাকায় আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। মামলা নং ৬০/২০২৪।
বিজ্ঞ আদালত উক্ত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করে একটি আদেশ প্রদান করে এবং কোন পক্ষকেই অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ না দেওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করে।
নিষেধাজ্ঞার এই আদেশের বিষয়ে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলে), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, (রাজস্ব) জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় সহ সকল দপ্তরকে অবহিত করা হয়।
কিন্তু উদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে একটি বিশেষ পক্ষকে অনৈতিক সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ২৬/০২/২০২৫ ইং তারিখ (বুধবার) মৌখিক নোটিশে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এর কার্যালয়ে এলে শাখার মিস কেস নং: ২৯(Xlll)২০২৪-২৫ এর প্রথম পক্ষ রবিলা খাতুন; পিতা: মৃত মফিজ উদ্দিন ও দ্বিতীয় পক্ষ মোঃ সারোয়ার হোসেন মন্ডল; পিতা: মৃত মিয়া বকশ মন্ডল এর মধ্যে অধিগ্রহণকৃত ভূমির বিরোধ সংক্রান্ত শুনানি কার্যক্রম পরিচালনা করে।
শুনানিতে দ্বিতীয় পক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কে আদালতে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে অবহিত করে আদেশের কপি উপস্থাপন করেন। কিন্তু অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ আজিম উদ্দিন বিষয়টি আমলে না নিয়ে এবং বিজ্ঞ আদালতের আদেশ অমান্য করে প্রথম পক্ষ রবিলা খাতুনকে ৯৯ শতাংশ ভূমির ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মোছাঃ সুমাকে আদেশ প্রদান করেন।
এই বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোঃ আজিম উদ্দিনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
উল্লেখ্য, কেওয়াটখালি সেতুটি অষ্ট্রেলিয়ার সিডনী হারবার ব্রীজের মত ষ্টীল সেতু বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরকে। এই প্রকল্পটির মোট ব্যয় তিন হাজার ২৬৩ কোটি ৬৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ হাজার ৩৫৩ কোটি ৮২ লাখ ও বাকী অর্থ এশিয়ান অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইবিবি) দেওয়ার কথা।
কেওয়াটখালী আর্চ স্টিল সেতু প্রকল্পটির কাজ ০১/০৭/২০২১ইং তারিখে শুরু হয়ে ৩০/৬/২০২৫ ইং তারিখে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের হস্তক্ষেপে নকশা পরিবর্তনের কারনে অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণের কারনে এই প্রকল্পের ব্যয় ৩ হাজার ২৬৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা থেকে আরও প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।
নতুন প্রযুক্তির এই স্টিল আর্চ (ধনুক) সেতুর নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ৩৩ দশমিক ২ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত রয়েছে। মূলত এই অধিগ্রহণখাতে মাত্রাতিরিক্ত টাকা ব্যয়ের অপকৌশলের পাশাপাশি ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণকেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ একটি চক্র সেতু প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা লুটপাট নিশ্চিত করতেই ত্রুটিপূর্ণ নকশায় ঘুরিয়ে পেচিয়ে সংযোগ সড়কটি ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা ও শতাধিক মিল-কারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নেওয়া হয়েছে। এটিকে ঘিরেই শুরু হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণকেন্দ্রিক লুটপাটের কার্যক্রম।
আরও পড়ুন: কেওয়াটখালী সেতুর সংযোগ সড়কের নকশা পরিবর্তনের নেপথ্যে দুটি হাউজিং কোম্পানীকে সুবিধা প্রদান
জমির শ্রেণীর পরিবর্তন করাসহ কারো নিচু নামা চাষাবাদের ভূমিকে ভিটে বাড়ি দেখানো, টিনের বস্তি সাদৃশ্য ঘরকে বিরাট আয়তনের কারখানা হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে। লাখ টাকার সম্পদ-স্থাপনাকে কয়েক কোটি টাকা মূল্য নির্ধারণের নকশা আঁকাআঁকির অপকর্ম চলছে জোরেসোরেই। এর সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে তড়িঘড়ি করে বিরোধপূর্ণ জমির ক্ষতিপূরণ প্রদান।
অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, সেতুর সংযোগ সড়কটি ময়মনসিংহ মহাসড়কের বাইপাস মোড় থেকে শুরু হয়ে কেওয়াটখালি এসে সেতুর পশ্চিম প্রান্তে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু সেতুর পূর্ব প্রান্তের সংযোগ সড়কটি উত্তর-পূর্ব দিকে কিছুটা অগ্রসর হয়ে আবার পেছন ফিরে পশ্চিম দিকে দুটি রেলওয়ে ওভারপাস ফ্লাইওভার আকারে পেরিয়ে টোল প্লাজা পর্যন্ত পৌঁছে আবারও উত্তর দিকে চায়না মোড়ের দিকে অগ্রসর হয়েছে। অথচ সেখানেও সংযোগ সড়কটি যুক্ত না করে দুটি র্যামে বিভক্ত করা হয়।
বিভক্ত একটি র্যামকে পূর্ব দিকে চলমান চার লেন মহাসড়কে একশ‘ মিটার ওভারপাস দ্বারা ক্রস করে উত্তর পাশ দিয়ে রংধনুর আকৃতিতে যাওগরা স্কুলের সামনে মূল সড়কে সংযুক্তি দেখানো হয়। আরেকটি র্যাম চার লেন মহাসড়কের দক্ষিণ পাশ যাওগরা স্কুলের বিপরীত পাশে মূল রাস্তায় মিলিত হয়েছে।
অথচ ফ্লাইওভারটি পেছন দিকে না ঘুরিয়ে সরাসরি নেয়া হলে অন্তত এক হাজার মিটার সংযোগ সড়ক কমে যেতো। এক্ষেত্রে শত কোটি টাকা নির্মাণ ব্যয় যেমন কমতো, তেমনি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ভূমি অধিগ্রহণেরও প্রয়োজন হতো না। কারণ সংযোগ সড়কটি সরাসরি নেয়া হলে সেখানে বেশিরভাগই ছিল খাস ভূমি। ফলে ভূমি অধিগ্রহণ খাতে মাত্র এক তৃতীয়াংশ খরচ হতো বলেও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা মন্তব্য করেছেন।
এসব কারণে কেওয়াটখালি সেতু নির্মাণ প্রকল্পের বিপুল পরিমাণ টাকা যেমন অপচয় হচ্ছে তেমনি প্রকল্পটি কাঙ্খিত জনকল্যাণ নিশ্চিতকরণে ব্যর্থ হওয়ারও আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান সরকার জনস্বার্থে দ্রুত এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি সমাধান করে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ণ করবে বলে এলাকাবাসী আশায় বুক বেঁধে আছে।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.