বিশেষ প্রতিনিধি
Published:2025-04-16 20:39:25 BdST
ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর কে এই মামুন?
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের বিভিন্ন দপ্তরে বদলি করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তারা অন্তবর্তী সরকারের কর্মকান্ড ব্যাহত করতে নানা ধরনের ক্ষতি ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। রাতারাতি ভোল্ট পালটিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন এমন তথ্যও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এর বিনিময়ে লাখ লাখ টাকাও খরচ করছেন রাজনৈতিক নেতাদের পেছনে। তাদেরই একজন নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আল মামুন।
নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আল মামুন সিভিল এভিয়েশন, ই.এম বিভাগ-১ বিমান বন্দর, বর্তমানে ই.এম-৩ এর ঢাকার দায়িত্বে কর্মরত রয়েছেন। তিনি পতিত সরকার আমলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে, টেন্ডার বাণিজ্য, ভুয়া বিল ভাউচার এবং কাজ না করেই ঠিকাদারের মাধ্যমে শতশত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে গুরুত্বর অভিযোগ রয়েছে। আরো অভিযোগ উঠেছে যে, তিনি স্বর্ণ চোরাচালানী করে অবৈধভাবে শত শত কোটি টাকার অবৈধ অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে মামুন ছিলেন দাপুটে অফিসার হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। ক্ষমতার পালা বদলে তিনি হঠাৎ করে বিএনপির একাধিক নেতার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। তারা টাকার বিনিময়ে মামুনকে শেল্টার দিচ্ছেন বলে কানাঘুঁষা চলছে। তবে বিষয়টি বিএনপির হাইকমান্ডকে অবগত করা হলে নেতৃবৃন্দ বলেন, এদের জন্য দলের ক্ষতি হচ্ছে। এরা দলের চেয়ারপারসনসহ বিভিন্ন নেতাদের নাম ব্যবহার করছে। অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত মোঃ মামুনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ জমা পড়েছে বলে দুদক সূত্রে খবর জানা গেছে।
দুদকের লিখিত ওই অভিযোগ থেকে জানা যায়, ঢাকা বিমান বন্দরে সিভিল এভিয়েশনে কর্মরত আছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আল মামুন। তিনি দীর্ঘদিন যাবত সিভিল এভিয়েশনের ই,এম বিভাগ-১ এ কর্মরত থেকে ভুয়া কাজের টেন্ডার দেখিয়ে ঠিকাদারের সাথে যোগসাজস করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। তিনি বিমানবন্দরের সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত। মামুন অবৈধ ভাবে শত শত কোটি টাকার অবৈধ অর্থ সম্পদ অর্জন করেছেন।
উক্ত কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ সরকারের বিমান ও পর্যটন মন্ত্রীর সাথে সিন্ডিকেট করে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সবাইকে থোড়াই কেয়ার করতেন। এখন আবার বিএনপি’র স্থানীয় নেতাদের সাথে যোগসাজস করে দুর্নীতি করে চলছেন। তার অপরাধ ঠেকাতে বিএনপির চেয়ারপারসন সহ কেন্দ্রীয় নেতাদের নাম বিক্রি করা হচ্ছে। তাতে দলের বদনাম হচ্ছে। মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ঢাকতে তারা তৎপর হয়ে উঠছে।
মামুনের সম্পদের বিবরণী
ঢাকার উত্তরায় ১২ নম্বর সেক্টরের ৮ নং- রোডে, বাড়ী নং-১০৫ এ একটি ফ্লাট রয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আল মামুনের নামে। যার আয়তন ২১০০ বর্গফুট ও ক্রয় মূল্য দুই কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা।
রাজউক পূর্বাচলে ৮ কাঠার একটি প্লট (স্টেডিয়ামের পাশে) আছে যার ক্রয়মূল্য দশ কোটি টাকা।
তিনি ঢাকার আশুলিয়ায় ২ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। যার ক্রয়মূল্য পঞ্চাশ কোটি টাকা। কেরাণীগঞ্জ থানার অর্ন্তগত হাইওয়ে রোডের সাথে ১ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন বারো কোটি টাকা দিয়ে।
ঢাকার গুলশান-২, রোড-৩, বাড়ী নং-৪১, ১টি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন পাঁচ কোটি টাকা মূল্যে। পান্থপথে ১টি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন দুই কোটি টাকা দামে।
নিজ জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে পিতার নামে, ভাই, বোনদের নামে, নিজের নামে ও স্ত্রীর নামে জমি ক্রয় করেছেন ১৫০ বিঘা। যার ক্রয় মূল্য পনের কোটি টাকা। এছাড়া
বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে নামে বেনামে এফডিআর আছে একশত কোটি টাকার।
কানাডায় মামুন তার স্ত্রীর নামে একটি বাড়ী ক্রয় করেছেন বারো কোটি টাকা দিয়ে। কানাডায় তার স্ত্রীর নামে শেয়ার ক্রয় করেছেন তিনশত কোটি টাকার।
অভিযোগে প্রকাশ, এলজিপি প্যানেল ক্যাব এর ভিআইপি ও আন্তর্জাতিক টার্মিনালের ভেতরে অত্যাধুনিক এলইডি লাইটের বিষদ বিবরন সহ টেন্ডারে বড় ধরনের জালিয়াতি করেছেন মামুন সিন্ডিকেট। অত্যন্ত চমৎকার ও গুনগত মান সম্পন্ন পন্য সরবরাহের কথা কাগজে থাকলেও বাস্তবে হয়েছে উল্টো। অধিকাংশ মালামাল চায়না থেকে ক্রয় করা হয়েছে। পতিত সরকারের স্থানীয় নেতা রাফিজ, তার ভাই রাকিব, ছেলে ফুয়াদ এবং শ্যালক উত্তরার মুকুল সহ এই সিন্ডিকেট বিমানবন্দরের ই.এম-১ বিভাগ সহ সব জায়গায় একচেটিয়া কাজ করেছেন। আর এই কাজে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকোশলীসহ সকল কর্মকর্তাদের রাজী খুশি করেই বছরের পর বছর ধরে কাজ চালিয়েছেন।
মূলত: ই.এম-১ বিমানবন্দরের অত্যন্ত স্পর্শকাতর অংশের মেকানিকাল ও ইলেকট্রিক্যাল এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন মামুন। বর্তমানে ই.এম-৩ এ কর্মরত আছেন তিনি। ই.এম-১ থাকাকালীন সময়ে নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
প্রকৌশলী মামুন বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। তার বড় ভাই ঠাকুরগাঁও আওয়ামী লীগ নেতা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী শাহীন আলমও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। পতিত সরকার আমলে তাদের ক্ষমতার দাপটে সবাই থাকতেন তটস্থ। এদের কারনে সরকারের কাছ থেকে চড়ামূল্য দেখিয়ে আর্থিকভাবে দূর্নীতির মাধ্যমে ঠিকাদার কর্তৃক নিম্নমানের পন্য সরবরাহ করা হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, 831919 নং টেন্ডারের কাজটি করেছে রাফিজ এন্টারপ্রাইজের কর্নধার ফুয়াদের প্রতিষ্ঠান। এই ফুয়াদ সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সুবিধাভোগী ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নামে বেনামে ঠিকাদার। জাহিদ মালেকের অবৈধ সুবিধাভোগী হবার কারনে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাগ্নের লাইট কোম্পানী কসমো লাইটিং থেকে লাইটগুলো সরবরাহ করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্যাব এর স্টোর এর দায়িত্বে নিয়োজিত একজন জানান, যে এলজিপি প্যানেলগুলো এসেছে তা অত্যন্ত নিম্নমানের এবং সবগুলোর ভূয়া চায়না টেষ্টিং সার্টিফিকেট জমা দেয়া। এখানে উল্লেখ্য, টেন্ডারে ইউরোপীয়ান ও আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছিল।
ম্যাগামান নামক একটি কোম্পানি সহকারী প্রকৌশলী শাহীন আলমকে অনৈতিক সুবিধা প্রদান করে প্রথমে আজিজ নামক জনৈক ঠিকাদারের মাধ্যমে নিম্নমানের পন্যের ছোট একটা চালান গ্রহন করে। পরবর্তীতে বড় অংশের কাজ নির্বাহী প্রকৌশলীর অলিখিত নির্দেশনায় আরো নিম্নমানের পন্য সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাগনের প্রতিষ্ঠান বিডি থাই কসমো থেকে গ্রহন করা হয়।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, বিডি থাই কসমো লিঃ এক্সিম ব্যাংক গুলশান ২ শাখায় ঋণখেলাপি এবং বিগত কয়েক বছর তাদের আমদানী লাইসেন্সও স্থগিত রাখা হয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা যায়, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাগ্নে এই কসমোর মাধ্যমে মানি লন্ডারিং করে দেশের বাইরে শত শত কোটি টাকা পাচার করেছেন।
ই.এম ১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন, সহকারী প্রকৌশলী শাহীন সাবেক সৈরাচারী সরকারের মদদপুষ্ট হবার কারনে ক্যাব ইএম-১ এ দূর্নীতি ও জালিয়াতির আখড়া বানিয়ে রেখেছেন। তারা সম্পূর্ণ অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
ভুক্তভোগী মহল জানিয়েছেন, মামুন ও শাহীন দুর্নীতির মাস্টার মাইন্ড ছিলেন। পতিত সরকার আমলে তারা রামরাজত্ব কায়েম করেছিলেন। তাদের অহংকার এবং তসরুপে পুরো ডিপার্টমেন্টের লোকজন ছিলেন অতিষ্ঠ। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। তবে এখন অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তারা মামুনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগের সুষ্ঠ তদন্ত দাবি করেছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা যায়, এই সংক্রান্ত একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে দুদক কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
এই ব্যপারে অভিযুক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আল মামুনের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.