বিশেষ প্রতিবেদক
Published:2025-05-18 11:46:07 BdST
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনাল নিয়ে কেন এতো বিতর্ক?
বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব কোনো বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া হবে কি না, এই নিয়ে বিতর্ক ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। এই সম্ভাব্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অনেকেই সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুবাইভিত্তিক একটি বিদেশি কোম্পানিকে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে এনসিটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সেই প্রক্রিয়া আবারও গতি পেয়েছে- এমন খবরে অনেকে এর বিরোধিতা করছেন।
তবে, পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় জানিয়েছে, এই বিষয়ে একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চলমান রয়েছে। সংস্থাটি লিখিতভাবে জানিয়েছে, সমীক্ষার সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
অন্যদিকে, সরকারের নৌ পরিবহন উপদেষ্টা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন (অব.) বলেছেন, বিদেশি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি সরকার নেতিবাচকভাবে দেখছে না।
তিনি জানান, সব অংশীজনের সাথে আলোচনা করেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এবং বিদেশি কোম্পানি দায়িত্ব পেলেও বন্দরের কারও চাকরি বা অন্য কোনো সমস্যা হবে না।
যারা এর বিরোধিতা করছেন, তাদের ভাষ্য- নিউমুরিং টার্মিনাল একটি আন্তর্জাতিক মানের এবং সক্ষমতার চেয়ে বেশি সেবা দিতে সক্ষম। এটির সম্প্রসারণের সুযোগও নেই, তাই নতুন করে বিনিয়োগের সুযোগও সীমিত।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, প্রধান উপদেষ্টা, ও তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাম্প্রতিক সময়ে বন্দর নিয়ে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তা থেকে অনেকে মনে করছেন, নিউমুরিং টার্মিনালের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিদেশি প্রতিষ্ঠানকেই দেওয়া হচ্ছে।
বন্দরের কর্মকর্তাদের ধারণা, সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) ডিপি ওয়ার্ল্ড নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে সরকারি- বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে জিটুজি ভিত্তিতে টার্মিনালটি পরিচালনার ভার দেওয়া হতে পারে।
এই টার্মিনালটি আলোচনার কেন্দ্রে থাকার কারণ হলো, এটি চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং এখানে একসাথে চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ ভিড়তে পারে। ৭০০ কোটি টাকা দিয়ে ২০ বছর আগে এই টার্মিনাল করা হয়েছে। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। স্বয়ংক্রিয় ক্রেন থাকায় দ্রুত কন্টেইনার ওঠানো-নামানোও সম্ভব। বন্দরের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর এই টার্মিনালে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিন লাখ কন্টেইনার বেশি ওঠানামা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি বন্দর পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড এবং এটিকে বিশ্বমানের হতে হবে। তিনি বন্দরের ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্বের সেরা অভিজ্ঞ কোম্পানিগুলোকে ডাকার কথা বলেছেন এবং কাজটি দ্রুত করার ওপর জোর দিয়েছেন।
বন্দর কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশি কোনো কোম্পানিকে টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সরকারের নির্বাহী বিভাগ এবং এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকবে পিপিপি কর্তৃপক্ষের।
বন্দরের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য মো. জাফর আলম মনে করেন, বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অভিজ্ঞ বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া বৈশ্বিক প্রবণতা। তবে, নিউমুরিং একটি সচল টার্মিনাল হওয়ায় বিদেশি কোম্পানি এখানে কোথায় বিনিয়োগ করবে এবং কীভাবে দক্ষতা বাড়াবে, তা স্পষ্ট করা উচিত।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হলে বন্দরের কানেকটিভিটির আওতায় বন্দর থেকে দিরাশ্রম পর্যন্ত ডেডিকেটেড কন্টেইনার করিডর এবং দিরাশ্রমে একটি আইসিডি নির্মাণে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ নিশ্চিত করা উচিত।
বন্দরের শ্রমিক-কর্মচারী ও অপারেটররা ইতিমধ্যেই নিউমুরিং বিদেশি হাতে না দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিক্ষোভও হয়েছে।
‘দেশ বাঁচাও বন্দর বাঁচাও’ কমিটির সদস্য শাহাদত হোসেন সেলিম জানিয়েছেন, সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে তারা শিগগিরই প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।
বাম গণতান্ত্রিক জোটও এই সিদ্ধান্তকে ‘রহস্যজনক ও চক্রান্তমূলক’ আখ্যা দিয়েছে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, এটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এবং অন্তর্বর্তী সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই। তারা বন্দরের কাজ বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.