June 26, 2025, 3:02 am


নিজস্ব প্রতিবেদন

Published:
2025-06-25 19:01:04 BdST

সংস্কারের তোয়াক্কা না করে লাগামহীন ঘুষবাণিজ্যে মাতোয়ারা নারায়ণগঞ্জ সদর সাব রেজিস্ট্রার


নারায়ণগঞ্জ সদর সাব রেজিস্ট্রার আব্দুল্লাহ আল ইমাম

  • দলিলের নকল তুলতেও সেবাপ্রার্থীদের সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয়।
  • সিন্ডিকেটে জিম্মি অফিস, ঘুষ ছাড়া হয় না কাজ।

বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব আদায়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত রেজিস্ট্রেশন বিভাগ। এনবিআরের পরেই এর অবস্থান। ৫ই আগস্ট বিপ্লবের পর বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে যেখানে সংস্কার চলছে বড় চ্যালেঞ্জিং নিয়ে। অথচ এত গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসেও সংস্কারের নামে ঘুষবাণিজ্যে এখনো লিপ্ত কিছু অসাধু কর্মকর্তা। এর মধ্যে অন্যতম নারায়ণগঞ্জ সদর সাব রেজিস্ট্রার আব্দুল্লাহ আল ইমাম।
ঢাকার লাগোয়া এলাকা নারায়ণগঞ্জ সদর সাব রেজিস্ট্রি অফিস সব সময় কর্মব্যস্ত থাকে। প্রতিদিন সেখানে দুই থেকে আড়াই শ বিভিন্ন শ্রেণির দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে থাকে। দলিল রেজিস্ট্রি করতে আসা লোকজনের মধ্যে স্থানীয়দের চেয়ে বহিরাগতদের সংখ্যাই বেশি। অনেকেই অগ্নিমূল্যের কারণে ঢাকার ভেতরে জমি কিনতে পারেন না। মূলত তাঁরাই নারায়ণগঞ্জ এলাকায় ছুটে যান। সহনীয় মূল্যে জমিও পেয়ে যান। কিন্তু তা রেজিস্ট্রি করতে আসার পরই শুরু হয় নানা বিপত্তি। টেবিলে টেবিলে ঘুষ, তবে এ শব্দটির বিকল্প উচ্চারণে বলতে হয় ফিস দিচ্ছি। এমন অভিনব কায়দায় আদায় হচ্ছে ঘুষ। কেরানি, মোহরার, টিসি মোহরার, এক্সট্রা মোহরার —সবাই হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে কথিত সেই ফিসের জন্য। তবে সবচেয়ে বড় ফিসটি দিতে হয় সাবরেজিস্ট্রারকে। তবে সেটা সরাসরি দেওয়ার সৌভাগ্য হয় না। সেটা গ্রহণ করার জন্য তাঁর মনোনীত একজন বিশেষ উমেদার তৌহিদ ও মোহরার টিটু রয়েছেন।
এদের কাছেই সাবরেজিস্ট্রারের সব রকম ফিসের হিসাব-নিকাশ। অফিস শেষে বাড়ি ফেরার সময় ব্রিফকেসে করে সে ফিস গাড়িতে তুলে দেওয়ার পর তাদের দায়িত্ব শেষ হয়। নারায়ণগঞ্জ সদর সাব রেজিস্ট্রি অফিসে গত ৬ মাসে নজিরবিহীন অনিয়মের অভিযোগে উঠেছে। এছাড়াও একাধিক দলিলে জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অভিযোগও কোনো অংশে কম নয়, ফলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এদিকে প্রাতিষ্ঠানিক টিমের তদন্ত চিত্রে উঠে আসা তথ্য বলছে, দাতাগ্রহিতার মধ্যে জমির প্রকৃত বিনিময় মূল্য বেশি হলেও তা সাব-রেজিস্ট্রার ও দলিল লেখকদের সহায়তায় কম দেখানো হয়। যে কারণে প্রকৃত রেজিস্ট্রেশন ফি হতে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। দলিলে লিখিত মূল্যের অতিরিক্ত টাকা বিক্রেতার পক্ষে কালো টাকায় পরিণত হয়। একইভাবে ক্রেতার কালো টাকাও সাদা হয়ে যায়। এতে করেই ত্রিমুখী দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর ফলে দলিল রেজিস্ট্রেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবৈধ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করছে। জমি রেজিস্ট্রিকালে জমাকৃত জাল পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট কিংবা চেক নির্ধারিত সময়ে জমা না দেয়ার কারণে ধরা পড়ছে না। এসব চেক ও পে-অর্ডার এন্ট্রি দেয়ার জন্য রক্ষিত রেজিস্ট্রারের সকল কলামগুলো পূরণ করা হচ্ছেনা।

শুধু তাই নয়, প্রতি দলিলে অফিস খরচের নামে অতিরিক্ত টাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের মধ্যে বণ্টন হয়ে যায়। টাকা না দিলে দলিলে ইচ্ছা করে ভুল করা কিংবা দলিল আটকে রেখে হয়রানির ঘটনাও ঘটে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের উমেদার তৌহিদ, মোহরার টিটু ও দলিল লেখক ভেন্ডার সমিতি নেতাদের সখ্যতায় শক্তিশালী সিন্ডিকেটে গড়ে উঠেছে। কাগজপত্রে বিন্দুমাত্র ভুল পেলে যেন ঘুষের মাত্রাও বেড়ে যায়। নির্ধারিত ফির বাইরে অতিরিক্ত টাকা না দিলে কাজ হয় না এই অফিসে। জমির দলিল আটকে রেখে ভুক্তভোগীদের চাপের মুখে ঘুষ দাবি সাব-রেজিস্ট্রার, উমেদার ও নকলনবিশদের নিয়মিত আচরণে পরিণত হয়েছে।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে কিছু দলিল লেখক জানান, দলিল রেজিস্ট্রির সরকারি ফি ব্যতীত অফিস খরচের নামে বাড়তি টাকা দিতে হয়। অতিরিক্ত টাকা না দিলে তাঁরা দলিলে অযৌক্তিকভাবে নানা ভুল দেখিয়ে হয়রানি করেন। অতিরিক্ত খরচের অর্ধেকাংশ ভাগ জমা হয় সাব-রেজিস্ট্রারের নামে।
ভুক্তভোগীরা জানান, দলিলের নকল আবেদন করার পর কর্মচারীদের ঘুষ না দিলে তাঁরা মাসের পর মাস ঘোরাতে থাকেন। বলতে থাকেন, দলিল এখনো হয়নি বা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার ঘুষ দিলে সঙ্গে সঙ্গেই দলিল বের করে এনে দেওয়া হয়। দলিলে কোনো ধরনের সমস্যা থাকলে চুক্তি করে ঘুষ নিয়ে কাজ করে দেওয়া হয়। জমি বিনিময় কিংবা বণ্টনের সময় ইচ্ছেমতো ঘুষ আদায় করেন কর্মচারীরা। কোন সেবার জন্য কত টাকা ফি লাগবে, তার মূল্যতালিকা অফিসের দেয়ালে টাঙানো থাকলেও নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করেই তারা কার্যক্রম চালাচ্ছে।
রেজিস্ট্রি অফিসের এক মোহরার জানান, প্রতিটি দলিল সম্পাদনের বিপরীতে দলিলে উল্লিখিত জমির মোট মূল্যের ওপর ১ শতাংশ টাকা অফিসকে দিতেই হবে। এই ১ শতাংশ টাকা অফিসকে না দিলে দলিল সম্পাদন হয় না। ১ শতাংশ খরচের মধ্যে বরাদ্দ সাব রেজিস্ট্রার খরচ, আউটসোর্সিংয়ে নকল নবিশদের খরচ, আফিস খরচ ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, দলিলের নকল উঠাতেও গুনতে হয় বাড়তি দুই থেকে তিন হাজার টাকা।
অনিয়ম প্রসঙ্গে উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার আব্দুল্লাহ আল ইমামের সরাসরি সাক্ষাৎকার নিতে গেলে ব্যস্ততার নানা টালবাহানা দেখায়, পরবর্তীতে তাকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.