September 20, 2024, 11:53 am


নেহাল আহমেদ

Published:
2024-08-15 12:15:08 BdST

লাশ আনতে দিতে হয়েছে ঘাটে ঘাটে টাকা


আমরা যখন রাষ্ট্র সংস্কারের শহীদ আব্দুর গনির বাড়ী যাই তখন একটি এনজিও কর্মী  টাকা নেয়ার জন্য বসে আছে। ছয় বছরের শিশু কন্যাটিও বুঝে গেছে তার বাবা নেই। কিস্তির টাকা তার মাকে দিতে হবে।
আব্দুল গনির লাশ আনতে একটি পুলিশ ক্লিয়ারেন্স আনতে ঘুরতে হয়েছে তিন থানায়। এই থানা থেকে বলে ওই থানায় যান। সেই থানায় গেলে বলে ওই থানায় যান। পরে শাহবাগ থানায় একটি জিডি করে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করানো হয়। সুরতহাল রিপোর্ট করানোর জন্য পুলিশকে দেওয়া লাগছে ছয় হাজার টাকা। পরে সেই লাশ বাড়ি পর্যন্ত আনতে খরচ হয় আরও ২৫ হাজার টাকা। এমনটাই বলছিলেন কোটা আন্দোলনের সময় গুলিতে নিহত হওয়া আব্দুল গণির ভাই আব্দুর রাজ্জাক।

গত ১৯ জুলাই কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষের মধ্যে ঢাকার শাহজাদপুর বাঁশখালী এলাকায় মাথায় গুলি লেগে নিহত হন আব্দুল গনি (৪৫)। আব্দুল গনি রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানখানাপুর ইউনিয়নের নতুন বাজার এলাকার আব্দুল মজিদ শেখের ছেলে। তিনি ঢাকার একটি আবাসিক হোটেলে কাজ করতেন। ২১ জুলাই ময়না তদন্তের পর রাত সাড়ে আটটার দিকে গ্রামের একটি কবরস্থানে আব্দুল গণির দাফন সম্পূর্ণ হয়।

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, গত ১৯ জুলাই সকাল ১০টার দিকে আব্দুল গণির ফোন থেকে কেউ একজন আব্দুর গণির বাবার নাম্বারে ফোন করে বলেন এই ফোনের মালিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তার লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পরে আছে। এই খবর পাওয়ার পর আমি আর আব্দুল গণির ছেলে আলামিন ঢাকাতে যাই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মর্গে গিয়ে লাশ সনাক্ত করি। পরে সেখান থেকে বলে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স নিয়ে আসেন।

আব্দুল গণি মারা যায় ঢাকার বাঁশখালী এলাকায়। সেখানে তিন থানার সীমানা। গুলশান, বাড্ডা থানা ও ভাটারা থান। আমরা প্রথমে যাই বাড্ডা থানায়। সেখান থেকে বলে এটা আমার থানার অধীনে নয়। তারপর যাই ভাটারা থানায় । তারাও একই কথা বলে। এরপর যাই গুলশান থানায়। । এভাবে ১৯ জুলাই বিকেল থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত বাড্ডা থানায় ৫বার, গুলশান থানায় ৩ বার ও ভাটারা থানায় ৬ বার যাই । তার পরও কোন থানাই আমাদের ক্লিয়ারেন্স দেয় না।

পরে শাহবাগ থানায় গিয়ে কথা বলি। সেখানে রাজবাড়ীর একজন পুলিশ সদস্য ছিল । সে আমাদের সহযোগিতা করে। তার পর শাহাবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করি। পরে পুলিশ গিয়ে লাশের সুরতহাল করে। এজন্য সেই পুলিশ সদস্যকে দিতে হয় ৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে লাশ মেডিকেলের ফ্রিজে রেখে দেয়। আমরা বলেছিলাম ফরেনসিক ওয়ার্ডের ফ্রিজে রাখার জন্য। কিন্তু হাসপাতাল কতৃপক্ষ রাখে বড় ফ্রিজে।

২১ তারিখ আমাদের আবার লাশ খুঁজতে তিনটি মর্গে ঘুরতে হয়। লাশ খোজার জন্য মর্গের যে ব্যক্তিরা দায়িত্বে আছেন। তাদের তিন মর্গের তিনজনকে মোট ২ হাজার ১০০ টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে তারা লাশ দেখায় না। এরপর লাশ গোসল করানো, এম্ব্যুলেন্স ভাড়া ও কফিন মিলে আরও দিতে হয় ২০ হাজার টাকা।

সোমবার আব্দুল গণির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রাজবাড়ী খানখানাপুর বড় ব্রিজ সংলগ্ন মোস্তফার ভাটার উপর দিয়ে আব্দুল গণির বাড়িতে যাওযা রাস্তা। বাড়িতে একটি নতুন বিল্ডিং ওঠানো হচ্ছে। বিল্ডিংয়ের ছাঁদ সম্পূর্ণ হয়েছে। ভেতরের রুমের চারপাশের দেওয়ালের বসানো হয়েছে। বিল্ডিংয়ের সামনে একটি ছোট টিনের ছাপড়রা করে সেখানে থাকে আব্দুল গণির পরিবার। বাড়িতে চলছে নীরবতা।

কথা হয় আব্দুল গণির স্ত্রী লাকি আক্তারের সাথে।
লাকি আক্তার বলেন, আমার ৫ বছরের মেয়ে সব সময় বলে আমার বাবাকে এনে দাও। আমার ছেলেটি একটু বড় হয়েছে। পড়ালেখা করতো। তার মুখের দিকে তাকানো যায়না। ওদের বাবার (আব্দুল গনি) স্বপ্ন ছিল সন্তানদের লেখাপড়া করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করবে। এখন আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমার বাবার দেওয়া একটি জমিতে একটি ঘরের কাজ ধরেছিলাম। একটু একটু করে কাজ করছিলাম। এবছর প্রায় তিন লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ঘরের কাজ করেছি। এই ঘরে থাকা আর তার ভাগ্যে হলো না।

লাকি আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী ছিল সংসারের এক মাত্র উপার্জনকারী। আমার বাবাও নেই। স্বামীও মারা গেলো। আমার গার্জিয়ান বলতে এখন আমার কেউ নেই। আমি প্রায় তিন লাখ টাকা ঋণ আছি। আমার যে দুজন বাচ্চা আছে। আমি তাদেকে নিয়ে কিভাবে চলবো? এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কেউ কোন খোঁজ নেয়নি। আমার প্রশ্ন হলো আমার নিরীহ স্বামীকে কেন মারা হলো। আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই’।

আব্দুল গণির কলেজ পড়ুয়া ছেলে আলামিন বলেন, আমার বাবাই এই সংসারের সকল ব্যয়ভার বহন করতেন। এখন বাবা নেই। আমার মা আছে। ছোট একটি বোন আছে। আমি পড়ালেখা করতাম। এখন আর সেটা হবে না। সংসারের হাল আমাকেই ধরতে হবে। এখন আমার একটি কাজের দরকার। দেশে নতুন সরকার এসেছে। যদি আমার একটি কাজের ব্যবস্থা করে দিতো। তাহলে আমরা পরিবার ধরে বেঁচে যেতাম।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা