April 12, 2025, 11:39 pm


কূটনৈতিক প্রতিবেদক

Published:
2025-04-12 16:24:20 BdST

ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে ভারতের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের নেপথ্যে যা


একবছর আগে থেকেই ভারতের রফতানিকারকরা দিল্লি হয়ে বাংলাদেশের পণ্য রফতানির বিরোধিতা করে আসছিলেন। এনিয়ে গত বছরের (২০২৪) ঠিক এই এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকও করেছিলেন দেশটির পণ্য রফতারিকারকদের সমিতির নেতারা।

তাদের দাবি ছিল, দিল্লি বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক কার্গো টার্মিনালে বাংলাদেশি পণ্যবাহী ট্রাকের ভিড় এত বেড়ে গেছে যে, তাদের টার্ন পাওয়াই মুশকিল হয়ে গেছে! এয়ারপোর্টে অপেক্ষার সময় বেড়ে গেছে, চাহিদা আচমকা বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন এয়ারলাইনের কার্গোতে স্লট পাওয়াই মুশকিল হয়ে গেছে এবং হ্যান্ডলিং এজেন্টরাও সুযোগ বুঝে তাদের বাড়তি মাশুল চার্জ করছেন!

নিজ দেশের ব্যবসায়ীদের এমন দাবির পরও দেশটির সরকার তখন কোনও উদ্যোগ নেয়নি। একবছর পর দুই দেশের সরকার প্রধানের বৈঠকের ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় ভারত কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলো, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। মোদি সরকারের এমন আকস্মিক সিদ্ধান্ত শুধুই কাকতালীয় নাকি এর নেপথ্যে কাজ করছে অন্য কোনও কারণ?

গতবছরের ব্যবসায়ীদের দাবির বিষয়টি তুলে ধরে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতে তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন ‘অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিল’ তখন সরকারকে বলেছিল, যেভাবেই হোক আপনারা ভারতের বিমানবন্দরগুলো দিয়ে বাংলাদেশি পণ্যের রফতানিতে লাগাম টানুন, নইলে আমরা বিপদে পড়ছি। সংস্থার চেয়ারম্যান সুধীর সেখরি অবশ্য এই প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, দরকার হলে দিল্লিতে আরও বেশি এয়ার কার্গো পরিবহনের ব্যবস্থা করুন– যাতে ভারতীয় ও বাংলাদেশি গার্মেন্ট দুটোই সহজে ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠানো যায়।

ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনের অবস্থান ছিল আরও কঠোর। তারা বাণিজ্যমন্ত্রীকে সরাসরি বলেন, ‘গার্মেন্ট খাতে বাংলাদেশ হলো ভারতের প্রতিযোগী বা কম্পিটিটর দেশ– কাজেই ভারতের গার্মেন্ট নির্মাতাদের অসুবিধা করে কেন প্রতিদ্বন্দ্বী একটি দেশকে ভারত বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে এটাই তাদের বোধগম্য নয়। সংস্থার ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইশরার আহমেদের কথায়, ‘ভারত সরকারের নীতিতে ভারতের পণ্য অগ্রাধিকার পাবে, এটাই তো স্বাভাবিক!’

কিন্তু ঘটনা হলো, এসব দেন-দরবারের পরও বাণিজ্যমন্ত্রী তাদের নির্দিষ্ট করে কোনও আশ্বাস দিতে পারেননি বা দেননি। তখন ভারতে লোকসভা নির্বাচন চলছে। তিনি শুধু বলেছিলেন, ভোটের পর সরকার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবে।

জুন মাসের শুরুর দিকে নরেন্দ্র মোদির সরকার আবার ক্ষমতায় ফিরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু বাংলাদেশকে ভারত যে এই ‘ট্রান্সশিপমেন্টে’র সুবিধা তারও বছর চারেক আগে দিয়েছিল তা আদৌ পুনর্বিবেচনা করা হয়নি। এর কারণটাও সহজ– বাংলাদেশে তখন ক্ষমতায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি বন্ধু সরকার, যাদের ভারত কখনওই বিরাগভাজন করতে চায়নি।

এই ‘সুবিধা’র ইতিহাস খতিয়ে দেখতে হলে অবশ্য পিছিয়ে যেতে হবে সেই ২০২০ সালের জুন মাসে। তখন ভারতে চলছে কোভিড মহামারির লকডাউন। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কর্মকান্ডে চরম ভাঁটা পড়েছে, রীতিমতো ধুঁকছে ভারতের স্থল ও বিমানবন্দরগুলো। সেই অবস্থায় ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, প্রতিবেশী বাংলাদেশের রফতানিকারকরা চাইলে ভারতের বন্দরগুলো ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে তাদের পণ্য পাঠাতে পারবে– অর্থাৎ এই বন্দরগুলোকে ‘ট্রান্সশিপমেন্ট হাব’ হিসেবে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে।

অবশ্য ভারতের এই প্রস্তাব যে বাংলাদেশ প্রথমেই লুফে নিয়েছিল, তা নয়। বস্তুত ২০২৩ সালের শেষ তিন কোয়ার্টারেও (এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর) দিল্লি বিমানবন্দর দিয়ে যত পণ্য রফতানি হয়েছিল তার মাত্র দুই শতাংশ ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক ২০২৪ থেকে এই প্রবণতা করে বাড়তে থাকে।

বাংলাদেশি রফতানিকারকরা অনুধাবন করেন, দিল্লি বিমানবন্দর দিয়ে এয়ার কার্গো পাঠানোর অপশন অনেক বেশি। কারণ পৃথিবীর প্রায় সব বড় বড় এয়ারলাইনের দিল্লিতে উপস্থিতি আছে। খরচও ঢাকা বা চট্টগ্রামের তুলনায় অনেক কম। তা ছাড়া তখন লোহিত সাগরে অস্থিরতা চলায় সমুদ্রপথে পণ্য পাঠাতে কেপ অব গুড হোপ হয়ে অনেক বেশি সময় লাগছিল, কাজেই আকাশপথে রফতানির চাহিদাও বাড়ছিল।

বিশেষ করে বাংলাদেশের যে সব গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা ‘ফাস্ট ফ্যাশনে’র ব্যবসা করেন তাদের দ্রুত পণ্য পাঠানোটা খুব জরুরি, ফলে এই রুটটা তাদের কাছে খুবই লাভজনক হয়ে ওঠে। ইউরোপ-আমেরিকার ফ্যাশন শো-তে প্রদর্শিত যে সব পোশাকের স্টাইল খুব জনপ্রিয় হয়, দ্রুত সেগুলোর নকল তৈরি করে পশ্চিমের বাজারে ছাড়ার ঘটনাকেই বলে ‘ফাস্ট ফ্যাশন’– কিন্তু এই পোশাকগুলো যতদিন ট্রেন্ডিং থাকে তার মধ্যেই বাজারে আনতে হয় বলে সময়টা এখানে খুব গুরুত্বপূ‍র্ণ! দিল্লি তাদের এই সুবিধাটা দিতে পারছিল।

সব মিলিয়ে দেখা গেল গত বছরের শুরু থেকেই রোজ ৩০ থেকে ৩৫টি বাংলাদেশি পণ্যবাহী ট্রাক বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে দিল্লি বিমানবন্দরে আসতে শুরু করেছে। ওই বছরের প্রথম কোয়ার্টারে দিল্লি দিয়ে যে প্রায় ৯০ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আকাশপথে রফতানি করা হয়, তার প্রায় ১০ শতাংশই ছিল বাংলাদেশের।

এই গোটা ছবিটাই রাতারাতি বদলে গেল, বা বদলে দেওয়া হল গত ৮ এপ্রিল– যেদিন ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স অ্যান্ড কাস্টমসের এক হুকুমে বাতিল হয়ে গেল ট্রান্সশিপমেন্টের এই গোটা পদ্ধতিটাই! বেনাপোল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হল তৃতীয় দেশে রফতানির জন্য পাঠানো পণ্যবাহী বাংলাদেশি ট্রাক।

দু’দিন পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল ব্যাখ্যা দিলেন, বাংলাদেশকে এই সুবিধা দেওয়ার ফলে ভারতের বন্দরগুলোতে যে ‘কনজেসশন’ ও ‘ব্যাকলগ’ তৈরি হচ্ছিল, সেটা দূর করতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতদিন ভারতের রফতানিকারকদের অবকাঠামোগত বিলম্ব (লজিস্টিকাল ডিলে) হচ্ছিল ও বাড়তি খরচ হচ্ছিল এর ফলে, সেটাও জানালেন তিনি।

মুখপাত্র অবশ্য এটাও জানালেন, নেপাল ও ভুটানের মতো দেশে ভারতের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের রফতানি যেমন চলছিল সেটা তেমনই চলতে পারবে– ভারতের নতুন সিদ্ধান্তে তাতে কোনও প্রভাব পড়বে না। অবশ্য দিল্লি বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ কখনওই কোনও পণ্য নেপাল বা ভুটানে পাঠায় না।

ভারতের অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বললো, সরকারকে ধন্যবাদ কারণ তারা আমাদের বহুদিনের একটি দাবি মেনে নিয়েছেন! সংগঠনের সেক্রেটারি জেনারেল মিথিলেশ্বর ঠাকুর জানালেন, ভারতীয় রফতানিকারকদের এখন অনেক কম ‘ফ্রেইট রেট’ (পণ্য মাশুল) দিতে হবে এবং ভারতের বিমানবন্দরগুলোতেও চাপ কমবে।

কিন্তু এরপরও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, এই একই পরিস্থিতি তো গত বছরের এই সময়েও ছিল ... তাহলে তখন ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা বহাল রাখলেও এখন রাতারাতি তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হল কেন? তাও আবার ব্যাংককে বিমস্টেক শীর্ষ সম্মেলনের অবকাশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের মাত্র তিন দিন পরেই?

এর জবাবে দিল্লির পর্যবেক্ষকরা দুটো কারণ দেখাচ্ছেন– এক. এখন বাংলাদেশে যে সরকার ক্ষমতায় রয়েছে তাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আর তত বন্ধুত্বপূর্ণ নয়। আর দুই. অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক চীন সফরের সময় করা একটি মন্তব্য।

প্রথম কারণটি অবশ্য আজ নয়, গত আট মাসের ওপর ধরেই আছে। কিন্তু বেইজিংয়ে চীনের বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক সভায় অধ্যাপক ইউনূস ‘সেভেন সিস্টার্স’ নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন সেটাই যে আসল ট্রিগারের কাজ করেছে তাতে তাদের কোনও সন্দেহ নেই!

মুহাম্মদ ইউনূস ওই সভায় (২৮ মার্চ) বলেছিলেন, ভারতের সেভেন সিস্টার্স (উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো) একটি ল্যান্ডলকড বা স্থলবেষ্টিত এলাকা– আর ওই গোটা এলাকার সমুদ্রের একমাত্র অ্যাকসেস যেহেতু বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে, তাই বাংলাদেশই হল ওই অঞ্চলের সমুদ্রের অভিভাবক।

দিল্লি-ভিত্তিক থিংকট্যাংক ‘গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভে’র (জিটিআরআই) প্রধান অজয় শ্রীবাস্তবের বলতে কোনও দ্বিধা নেই, মুহাম্মদ ইউনূসের ওই মন্তব্যই আসলে ভারতের ‘আঁতে ঘা দিয়েছে’ এবং সে কারণেই বাংলাদেশকে দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সুবিধা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দিল্লি।

‘তিনি সেভেন সিস্টার্সের কথা বলে আসলে ভারতের ‘চিকেনস নেক’ বা শিলিগুড়ি করিডোরের ভালনারেবিলিটির কথাই বলতে চেয়েছেন বলে দিল্লির বিশ্বাস। তাও সেটা বলেছেন চীনের মাটিতে দাঁড়িয়ে – এবং সেই চীনকেই আবার লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন, যেটা এই স্পর্শকাতর করিডোরের খুব কাছে। ফলে ভারত এখন তার সরকারের ওপর পাল্টা চাপ দেওয়ার উপায় খুঁজবেই’, বলছিলেন অজয় শ্রীবাস্তব।

বিজেপি ঘনিষ্ঠ ফরেন পলিসি এক্সপার্ট শুভ্র কমল দত্ত আবার জানাচ্ছেন, ব্যাংককে মোদি-ইউনূ‍স বৈঠকের প্রস্তাব না থাকলে এই সিদ্ধান্ত হয়তো আরও কয়েকদিন আগেই নেওয়া হতো।

‘তবে আগামী দিনে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আরও কঠোর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে বলেও আমি ইঙ্গিত পাচ্ছি’, বলছিলেন ড. দত্ত।

ঢাকায় ভারতের হাই-কমিশনার ছিলেন, এমন একজন সাবেক শীর্ষ কূটনীতিবিদ আবার এই প্রতিকেদককে ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন এভাবে, ‘ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধাটা আসলে কী? এটা হল ভারতের ভৌগোলিক ও অবকাঠামোগত সুবিধাটা একটা বন্ধু দেশকে ব্যবহার করতে দেওয়া! এখন সেই প্রতিবেশী যদি সেভেন সিস্টার্সের কথা তোলে সেই ভূগোলকেই ভারতের দুর্বলতা হিসেবে তুলে ধরতে চায়, তাহলে এই ধরনের পাল্টা পদক্ষেপই প্রত্যাশিত নয় কি?

সুতরাং বেইজিংয়ে অধ্যাপক ইউনূসের মন্তব্য ও তার কয়েকদিনের মধ্যেই ভারতের ট্রান্সশিডমেন্ট বাতিলের সিদ্ধা্ন্ত– এই দুটো জিনিসকেই ‘ভূগোলকে কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার’ দৃষ্টান্ত হিসেবেই দেখছেন ওই সাবেক কূটনীতিবিদ।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.