মাহবুবুর রহমান
Published:2025-04-15 16:10:17 BdST
আইনে প্রতি শ্রদ্ধা ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের মিশনে অন্যতম সাবেক কাস্টমস কমিশনারএনবিআর সদস্য বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ: পর্ব - ১
গণমাধ্যমে বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত সরকারি কর্মকর্তা কাস্টমসের সাবেক কমিশনার এবং বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য বেলাল হোসাইন চৌধুরীর বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অঢেল জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠেছে।
মুখে আইনে প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার কথা বললেও পর্দার অন্তরালে অবৈধ ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মিশনে অন্যতম সফল সরকারি কর্মকর্তা হচ্ছেন এই বেলাল হোসাইন চৌধুরী।
বাংলাদেশ কাস্টমসের সাবেক কমিশনার ও বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (মূসক বাস্তবায়ন ও আইটি) পদে কর্মরত বেলাল হোসাইন চৌধুরীর বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এবং দালিলিক প্রমাণ থাকার পরও আইন কাঠামোর মধ্য থেকেও তিনি নিজেকে সফলতার এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, বেলাল হোসেন চৌধুরীর মতো সততা ও দুর্নীতির এমন অসাধারণ সমম্বয় করে চলা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জনকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।
রাজস্ব বিভাগের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে, রাজস্ব ফাকির মাধ্যমে তিনি হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। নানাভাবে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিতে তিনি সর্বদাই অসাধূ ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করেছেন। এতে সরকার বা রাষ্ট্র হারিয়েছে বহু বহুগুন অর্থ। যা জাতীয় উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেলাল হোসাইন চৌধুরীর গ্রামের বাড়ী নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি উপজেলায়। এই উপজেলাটিতে দেশের সবচেয়ে বেশী শিল্পপতিদের বসবাস। বলা চলে, দেশে মোটা দাগে পরিচিত শিল্পগ্রুপ গুলোর মালিকদের জন্মভূমি এই সোনাইমুড়ি উপজেলা।
এনবিআরে তার উচ্চপদে পদায়ন আর পরিচিত এলাকাভিত্তিক শিল্পপতি, সিএন্ড এফ এজেন্টদের ঘিরে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের উপর ভর করে রাষ্ট্রকে ঠকিয়ে বেলাল হোসাইন চৌধুরী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি দেশের বাইরেও অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বেলাল হোসাইন চৌধুরীর এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তিনি এলাকার মানুষের কল্যাণে অনেক দান করেন। কোন মানুষ এলাকার পরিচয়ে তার কাছে যেয়ে খালি হাতে ফিরেছেন এমন উদহরণ কম। তিনি এলাকাবাসীর কাছে রীতিমতো দাতা হাতেম তাই এর সমতুল্য একজন মানুষ। যদিও দান গ্রহণকারীরাও জানেন যে এটা তার অবৈধ অর্জনের টাকা।
নোয়াখালী ক্লাব নামের একটি ক্লাব আছে ঢাকার ফকিরাপুল এলাকায়। বিগত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট শাসনামলে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিমউদ্দিনসহ ফ্যাসিস্ট লুটপাটের সাথে সরাসরি যুক্ত শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই ক্লাবের ফান্ডে টাকা দিয়েছে। দাতাদের সেই তালিকায় মোটা দাগে কাস্টমস কর্মকতা বেলাল হোসাইন চৌধুরীর নামও রয়েছে।
এই নোয়াখালি ক্লাবের সাথে যুক্ত এবং বেলাল হোসাইন চৌধুরীর পরিবারের কাছাকাছি থাকা এক ব্যক্তি গণমাধ্যমকে জানান, বেলাল হোসেন চৌধুরীর টাকা ও সম্পদের হিসাব মেলানো যাবে না। দেশে বিদেশে তার কত সম্পদ আছে তা তালিকা করে শেষ করা কঠিন।
তিনি আরও যোগ করেন যে, তবে তিনি লোক ভাল। অত্যন্ত বিনয়ী এই বেলাল হোসাইন চৌধুরী সব সময়ই আত্মীয়, বন্ধু, এলাকাবাসীদের উপকার করেন।
তার দেয়া তথ্যমতে, বেলাল হোসাইন চৌধুরীর মামাতো ভাই হাশেম হচ্ছেন তার সমস্ত অবৈধ সম্পদ ও অর্থের পাহারাদার। এই হাশেনকে বেলাল হোসাইন চৌধুরী টাকা দিয়ে কোয়ান্টাম রিয়েল এস্টেট নামে এবং পরে কোয়ান্টাম ডেভেলপার নামে কোম্পানী খূলে দেন। যেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে বহু অর্থ। এই হাশেমের মাধ্যমেই কানাডাতে বাড়ী কিনেছেন বেলাল হোসাইন চৌধুরী। যে বাড়ীতে এখন তার পরিবারের সদস্যরা বসবাস করছেন।
সূত্র জানায়, বেলাল হোসাইন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত মেজর রবিউল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে কয়েকশত কোটি টাকা দিয়েছেন শেয়ার বাজারে প্রাথমিক শেয়ার ক্রয় করে কালো টাকা সাদা করার জন্য। তাছাড়া তার এক আত্মীয় মোয়াজ্জম হোসেনকেও মোটা অংকের টাকা দিয়ে ব্যবসায় লাগিয়েছেন। এই মোয়াজ্জম হোসেনের মাধ্যমে তিনি কক্সবাজারে একটি তিন তারকা মানের হোটেলের নির্মাণ করাচ্ছেন যার কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া এলাকার অনেককেই তিনি নিজের কালো কাটা সাদা করার কাজে লাগিয়েছেন। জমি, ফ্লাট, প্লটে তার বিনিয়োগ হিসাবের বাইরে।
ঐ সূত্র বলছে, এই কাজে আইনের চোখ ফাঁকি দিতে বেলাল হোসাইন চৌধুরী শুরু থেকেই সচেতন ছিলেন বলেই শত অভিযোগের পরও কর্মক্ষেত্রে তিনি বহাল তবিয়তে আছেন।
ঐ সূত্র আরও দাবি করেন যে, বেলাল হোসাইন চৌধুরীর হাত খোলা। তিনি একজন দক্ষ ম্যানেজ মাস্টার। তিনি বলেন তার সম্পদের লম্বা তালিকা রয়েছে, যার কিছু অংশ হয়তো গণমাধ্যমে মাঝে মধ্যে উঠে আসে। কিন্তু এসব তার সম্পদের ১০ শতাংশ হতে পারে।
ঐ সূত্রের দাবি দিনে কোটি কোটি টাকা আয় আছে বেলাল চৌধুরির। তার ভাষ্যমতে, বেলাল হোসাইন চৌধুরীকে কেউ কিছু করতে পারবে না। কারণ ফ্যাসিস্টদের সময় শেখ পরিবারের সাথে ও ওবায়দুল কাদেরের সাথে তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। আর এখন শিশু এক উপদেষ্টাকে মূলত তিনিই চালাচ্ছেন। টাকা ঢালছেন নবগঠিত ছাত্রদের রাজনৈতিক প্লাটফর্মে। আর বিএনপির নেতারাতো বহু আগে থেকেই তার পোষ্য হয়ে আছে। সব মিলে তিনি অনেকটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে!
এসব বিষয়ে ঐ সূত্রের কথার সাথে মিল পাওয়া যায় গণমাধ্যমে দুদুক ও এনবিআর সূত্রে প্রকাশিত নানা সংবাদ বিবরনীতে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, বেলাল হোসাইন চৌধুরীর বিরুদ্ধে কিছু সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের সঙ্গে যোগসাজশে দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নামে-বেনামে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আছে। তার বিরুদ্ধে বাড়ি, গাড়ি ও অবৈধ সম্পদসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ রয়েছে।
যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বেলাল হোসাইন চৌধুরী বলে আসছেন দুদকে দাখিল করা এসব অভিযোগের বিষয়ে এনবিআর নিরপেক্ষ তদন্ত করে। এনবিআরের সদস্য (শুল্কনীতি ও আইসিটি) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়ার নেতৃত্বে তদন্ত করেও আমার বিরুদ্ধে কিছুই পাওয়া যায়নি। এসব অভিযোগে আমার নামে যেসব বাড়ি ও ফ্ল্যাটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো অন্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে।
বেলাল হোসাইন চৌধুরীর সম্পদ বিবরণী
গণমাধ্যমে প্রকাশিত দুদকের বিবরনীতে প্রাথমিক অনুসন্ধানে বেলাল হোসাইন চৌধুরীর নামে-বেনামে যেসব সম্পদের তথ্য পেয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে, রাজধানীর বারিধারায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এফ ব্লকে ১২ নম্বর প্লটে ৫ কাঠা জমির ওপর ৫তলা বাড়ি। যার আনুমানিক মূল্য ৫ কোটি টাকা। নিউ ইস্কাটনে বিয়াম ভবনের পাশে বেস্ট উইশেস কোম্পানি থেকে বেলালের স্ত্রীর নামে কেনা হয়েছে চার কোটি টাকা মূল্যের চার হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট। বারিধারায় বসুন্ধরার ডি ব্লকে ৫ কাঠা ও পূর্বাচলে ১০ কাঠা আবাসিক প্লট। বসুন্ধরা সিটি ও যমুনা ফিউচার পার্কে আছে ৪টি দোকান।
এছাড়া, বেলালের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে ৫০ বিঘা জমি, আশুলিয়ায় ১০ বিঘা জমি ও গাজীপুরে বেলালের ভাইয়ের নামে সফিনা গার্মেন্টস কারখানার তথ্য পেয়েছে দুদক।
সম্প্রতি বেলাল হোসেন চৌধুরী বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে কানাডায় সুরম্য অট্টালিকা ক্রয় করেছেন। কানাডার সেই বাড়িতে তাঁর ছেলে-মেয়েরা বসবাস করে। এছাড়া বেলাল চৌধুরীর নামে যশোর এসপি অফিসের পাশে ১৫ কাঠা জমির ওপর ১৫ তলা ভবন নির্মাণ, ২ কোটি টাকা দিয়ে সিভিল সার্জন অফিসের পাশে ৩৩ শতাংশ জমি ক্রয় করে ৭৫ কোটি টাকা দিয়ে ১০ তলা ভবন নির্মাণের কথা জানা গেছে। অন্যদিকে নোয়াখালী শহরে ৭৫ কোটি টাকা দিয়ে ১০ কাঠা জমির ওপর ৬ তলা বাড়ি নির্মাণের কথাও দুদকে জমাকৃত অভিযোগে বলা হয়েছে।
৪৫, নিউ ইস্কাটনের যে ফ্ল্যাটে বেলাল হোসাইন চৌধুরী বর্তমানে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন সেই ফ্ল্যাটের মালিকানার সত্যতাও পাওয়া গেছে।
এতসব অভিযোগের পরও বেলাল হোসাইন চৌধুরী বার বার বলে আসছেন, আমার আয়কর ফাইলে যা আছে সেটাই আমার প্রকৃত সম্পদ, এর বাইরে আমার কোনো সম্পদ নেই। আমি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
(চলবে)
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.