September 17, 2024, 12:49 am


শাহীন আবদুল বারী

Published:
2024-08-22 15:13:15 BdST

অপকর্মের টাকায় ডিবি হারুনের দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড়


 পুলিশের এডিশনাল কমিশনার, ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ ওরফে হারুন মাসিক বেতন পেতেন ৮০ হাজার টাকা। আর মাসে ঘুষ-বাণিজ্য ছিলো কোটি কোটি টাকা। টাকার জন্য মানুষকে মেরে ফেলতেও হারুন পরোয়া করতেননা। অনেক শিল্পপতি, ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ হারুনের নাম বা ফোনে কন্ঠ শুনলেই আঁতকে উঠতেন। একটি ছোট বাচ্চাকেও ঘুম পাড়াতে হারুনের নাম বললেই বাচ্চাটি চোখ বুঝে ঘুমিয়ে যেতেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষেরাও ডিবি হারুনকে নামে চিনেন। হারুনকে টিভিতে দেখেও দোকানে, চায়ের স্টলে বেশ আড্ডা বা গল্প জুমতো। সবচেয়ে বেদনাদায়ক হলো হারুনকে একজন ব্যক্তিও ভালো জানতেননা। হারুন বহু আগ থেকেই জুলুমবাজ, অত্যাচারী ও নির্যাতনকারী পুলিশ অফিসার হিসেবে দেশের সর্বস্তরের জনগণের কাছে পরিচিত। এমনকি যে আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় হারুনের উত্থান তারাও হারুনকে নিয়ে নানা সমালোচনা করতেন।

হারুনের অগোচরে তার ডিপার্টমেন্টের অন্য সব পুলিশ সদস্যরা "খুনি হারুন" "গুম হারুন" ইত্যাদি উপাদি নাম দিয়ে ছিলেন। পুরো পুলিশ বাহিনীতে তার আলাদা পাওয়ার বা ক্ষমতার কাছে অনেকেই হেনস্ত ও জিম্মি ছিলেন।হারুনের ইচ্ছার বাইরে গেলে কিংবা মতের বিরোধ হলে তাকে বদলি বা কঠোর শাস্তি দিতেন। এসব কারণেই পদোন্নতি এবং আওয়ামী সরকারের খুব আস্থাভাজন ছিলেন হারুন। তাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পছন্দ করতেন এসব দুঃসাহসিক কাজের জন্য। আর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল হারুনকে দিয়ে অসাধ্য সব কাজ হাসেল করতেন।

গুম, হত্যা, নির্যাতন, নিপীড়ন, জুলুম, চাঁদাবাজি ছিলো হারুনের নেশা। এসব অপকর্মের টাকা নিয়েই হারুন দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তার অঢেল ধন-সম্পদের খবর পুলিশ সদস্যরাও জানতেননা। আস্তে আস্তে হারুনের সব অজানা কাহিনী ক্ষমতার উৎস, টাকার উৎস ও ধন-সম্পদের খবর একটার পর একটা বেরিয়ে আসছে। যা শুনে ও জেনে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের আঁতকে উঠছেন, অবাগ হচ্ছেন।

বিভিন্ন সুত্র থেকে হারুনের সম্পদের বিষয়ে জানা গেছে, সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব আছে হারুনের। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের নিউ হাইড পার্ক এলাকায় স্ত্রীর নামে পাঁচ মিলিয়ন ডলারের একটি বাড়ি কিনেছেন হারুন। উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডে (লেকপাড়ের রোডে) রয়েছে ৬তলা একটি আলিশান বাড়ি। এটি গেস্ট হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
একই রোডের মাথায় ৮তলা আরেকটি বাড়ি আছে হারুনের। ওই বাড়ির চতুর্থ তলায় পরিবার নিয়ে থাকতেন। উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ৭ নম্বর রোডের হোল্ডিং নম্বর-৫ এ ১০ কাঠা জায়গার ওপর একটি ১০তলা মার্কেট আছে। এটি হারুনের শ্বশুরের নামে করা হয়েছে। উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের ২১ নম্বরে ৬তলা একটি বাড়ি আছে। এই বাড়িটি বন্ধক রেখে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে।
উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের শাহ মখদুম এভিনিউয়ে ১২ নম্বর প্লটটির মালিক হারুন। এখানে তাজ ফুডকোর্টসহ কয়েকটি দোকান ভাড়া দেয়া হয়েছে। উত্তরা ১৩ নাম্বার সেক্টরের সোনারগাঁও জনপথ রোডের ৭৯ নম্বর হোল্ডিংয়ের একটি প্লট জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তির কাছে ভাড়া দেয়া আছে।
৩ নম্বর সেক্টরে ১৫ নম্বর রোডের ২৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে ১৪ তলা বাণিজ্যিক ভবন।
১৩ নম্বর সেক্টরে ৩ নম্বর রোডের ৪৯ নম্বর বাড়িতে ৬ তলা ভবন। ৩ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ১ নম্বর হোল্ডিংয়ে ৭ কাঠার বাণিজ্যিক প্লট রয়েছে।
১০ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডের ৩৯ নম্বর হোল্ডিংয়ে ৫ কাঠার একটি প্লট আছে।
৫ নম্বর সেক্টরে ৬ নম্বর রোডে ঢুকতেই প্রথমে ২৯ ও ৩০ নম্বর হোল্ডিংয়ের ১০ কাঠার দুটি প্লটের মালিক হারুন। শেষ দুটি প্লটের মধ্যে একটিতে টিনশেড ঘর বানিয়ে ভাড়া দেয়া এবং অন্যটি গোডাউন। ১৪ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডের ১৭ ও ১৯ নম্বর প্লট চারটি কোম্পানির শোরুম হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে । ১০ নম্বর সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ৪ নম্বর বাড়ির ৫ তলায় কথিত মামা জাহাঙ্গীরের অফিস। এই অফিসেই হারুনের সব সম্পত্তির কাগজপত্র রক্ষিত থাকে বলে জানিয়েছে জাহাঙ্গীরের ঘনিষ্ঠ সূত্র।
উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডের ১৪ নম্বর প্লটটি হিরন নামের এক ব্যক্তির কাছে ৩২ কোটি টাকায় বিক্রি করেছেন হারুন। ৩ নম্বর সেক্টরের সাবেক ৯ নম্বর রোড বর্তমানে রবীন্দ্র সরণিতে ৭ কাঠার ৪১ নম্বর প্লটটি মাসিক ১৪ লাখ টাকায় ভাড়া দেয়া আছে। ১১ নম্বর সেক্টরের উত্তরা স্মৃতি কেবল টিভি লিমিটেডের পাশে ৫ কাঠার আরেকটি প্লট ‘স্টার কার সেলেকশন’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেয়া আছে। এ ছাড়া ১৩ নম্বর সেক্টর, জম টাওয়ারের পাশে, উত্তরা থার্ড ফেইসে, পূর্বাচলে কয়েক ডজন ফ্ল্যাট রয়েছে হারুনের। বনানী কবরস্থানের দক্ষিণ পাশে ২০ কাঠার প্লট দখল করে একটি কোম্পানির কাছে ৭০ কোটি টাকায় বিক্রি করেন হারুন। টঙ্গীর সাতাইশ মৌজায় ৮ বিঘা জমিতে কোনো অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ করা হচ্ছে ‘জেএইচ-জিওটেক্স লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। টঙ্গীর গুশুলিয়া মৌজায় ছায়াকুঞ্জ-৫ আবাসিক প্রকল্পের ভেতরে ১২ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসিক হোটেল। তাছাড়া হারুনের নামে কিশোরগঞ্জে মিঠামইনে প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট নামে একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট রয়েছে। যেটি পরিচালনা করেন হারুনের ভাই ডাক্তার শাহরিয়ার। গাজীপুরে রয়েছে সবুজ পাতা রিসোর্ট এবং ‘গ্রিন টেক’ নামে আরও একটি বিলাসবহুল রিসোর্টের শেয়ার। এ ছাড়া নন্দন পার্কেও শেয়ার আছে হারুনের। আছে আমেরিকান ডেইরি নামে একটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ। এই কোম্পানির এমডি হারুনের স্ত্রী। ময়মনসিংহের ত্রিশালের সাবেক এমপি আনিসের সঙ্গে ফিশারিজ এবং রেস্টুরেন্টের যৌথ ব্যবসা আছে হারুনের। বিদেশে অর্থ পাচারের সুবিধার জন্য গড়ে তোলা হয় নিজস্ব মানি এক্সচেঞ্জ। ঢাকায় এই প্রতিষ্ঠানের অফিস পুরানা পল্টনের আজাদ প্রোডাক্টসের গলিতে। কার্যক্রম পরিচালনায় দুবাইয়ে আছে আরেকটি অফিস। এই মানি এক্সচেঞ্জ পরিচালনা করেন এডিসি সাইফুল ইসলামের দুই ভাই। একজন থাকেন দেশে। আরেক ভাই রিফাত অবস্থান করেন দুবাই।
সূত্রমতে, পুলিশের সাবেক এডিশনাল পুলিশ কমিশনার ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ হারুনের এসব সম্পদ যাচাই বাছাই করা হচ্ছে। তার নামে বেনামে বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট ও মার্কেটের বিষয় গুলো তদন্তে সঠিক প্রমাণিত হলে হারুনের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। ইতোমধ্যে দুদক অনুসন্ধান শুরু করেছে। সামনে আরো চমকপ্রদ তথ্য হারুনকে নিয়ে পাওয়া যাবে। হারুন কান্ডে স্ত্রী শামিমা আক্তারের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। হারুন পরিবারের সদস্য ছাড়াও তার অনেক ঘনিষ্ঠজন গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছেন।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from Crime & Corruption