আন্তর্জাতিক প্রতিবেদক
Published:2025-03-01 03:47:45 BdST
পাকিস্তানে রহস্যে ঘেরা এক বিমানবন্দর
সাজানো গোছানো চকচকে একটি বিমানবন্দর। রয়েছে বিলাসবহুল লাউঞ্জ, গাড়ি রাখার বিশাল পার্কিং লট। তাকলাগানো ফুড কোর্ট, রেস্ট রুম। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আর নিরাপত্তায় ঘেরা আদর্শ এক বিমানবন্দর যাত্রীসেবার জন্য। বিমানবন্দরের যাত্রীধারণ ক্ষমতা চার লাখ।
কিন্তু এই বিমানবন্দরের বাস্তবতা একটু ভিন্ন। কারণ এই বিমানবন্দরটিতে নেই কোনো যাত্রী, উড়ে না কোনো বিমান। ফলে এক রহস্যে পরিণত হয়েছে বিমানবন্দরটি। এই স্থাপনার আশপাশে রয়েছে দারিদ্র্যপীড়িত ও অশান্ত অঞ্চল, যা এর শান-শওকতের সম্পূর্ণ বিপরীত।
পাকিস্তানের আরব সাগর সংলগ্ন বেলুচিস্তান প্রদেশের গোয়াদর জেলায় চীনের ২৪০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়নে ২০২৪ সালের অক্টোবরে নির্মিত গওয়াদার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্বোধন নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে পিছিয়ে যায়। এছাড়া স্থানীয় বিদ্রোহীদের দাপাদাপির কারণেই গোয়াদরকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারছে না পাক প্রশাসন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ এবং চীনের প্রধানমন্ত্রী লি চিয়াং ভার্চুয়াল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করেন। কিন্তু প্রথম ফ্লাইটের সময় মিডিয়া ও সাধারণ জনগণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
পাকিস্তানের শেষ প্রান্তে আরব সাগরের উপকূলে অবস্থিত বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটায় অবস্থিত এই বিমানবন্দরে ইসলামাবাদ থেকে সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই।
অন্যদিকে, নবনির্মিত এই বিমানবন্দর থেকে দেশটির বৃহত্তম শহর তথা সিন্ধ প্রদেশের রাজধানী করাচিতে যাওয়ার বিমান রয়েছে। সপ্তাহে তিন দিন এই রুটে বিমান পরিষেবা চলবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। যাত্রীর অভাবে বর্তমানে এই রুটে সপ্তাহে একদিন মিলছে পরিষেবা।
সিপিইসি: রূপান্তরের আশ্বাস কিন্তু বাস্তবে তেমন পরিবর্তন নেই
গত এক দশক ধরে চীন বেলুচিস্তান ও গওয়াদারে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, যা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) নামে পরিচিত। এটি চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াং প্রদেশকে আরব সাগরের সঙ্গে যুক্ত করে। তবে গওয়াদারে তেমন কোনো উন্নয়নের প্রমাণ মেলে না। শহরটি জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। বিদ্যুৎ আসে ইরান থেকে বা সৌর প্যানেলের মাধ্যমে। পানীয় জলেরও ঘাটতি রয়েছে।
পাকিস্তান-চীন সম্পর্ক বিশ্লেষকদের দাবি, এই বিমানবন্দর পাকিস্তানের স্বার্থে নয়, তৈরি হয়েছে চীনের স্বার্থে যাতে গোয়াদর আর বেলুচিস্তানে প্রবেশাধিকার পায় বেইজিং।
আরব সাগরের কোলের শহরটিতে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্বোধন করে শাহবাজ শরিফ সরকার। এর নির্মাণে যাবতীয় খরচ করেছে চীন। আর্থিক দিক থেকে পাকিস্তানের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া প্রদেশে ওই বিমানবন্দর তৈরি করেছে চীন। গোয়াদরের ৯০ হাজার জনসংখ্যার অধিকাংশেরই বিমানের টিকিট কাটার মতো টাকা নেই।
গোয়াদর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উদ্বোধনের সময়ে এটিকে শাহবাজ় সরকারের সাফল্য বলে উল্লেখ করে ইসলামাবাদ। শুধু তা-ই নয়, গোটা প্রকল্পটিকে ‘বন্ধু’ চীনের উপহার হিসাবে দেখছিল তারা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই ইস্যুতে পাল্টা বিবৃতি দেয় বেইজিং। গোয়াদর বিমানবন্দর নির্মাণের অর্থ পাকিস্তানকে ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে বলে জানায় তারা।
এতে পাকিস্তান জুড়ে শুরু হয়েছে প্রবল বিতর্ক। এই বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন দেশটির ইসলামাবাদভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ আজিম খালিদ। তার কথায়, বিমানবন্দরের মালিকানা আছে চীনের হাতে। এর সঙ্গে পাক সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই।
চীনের তহবিলে ফোর্থ গ্রেড স্টেটের এই বিমানবন্দরে বৃহত্তম যাত্রীবাহী বিমান অবতরণ করতে পারবে। তিন হাজার ৬৫৮ মিটার লম্বা ও ৭৫ মিটার প্রশস্ত রানওয়ে দিয়ে এই বিমানবন্দরে কার্যক্রম চালাতে পারবে কার্গো বিমানও।
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরেরে শিপমেন্ট হাব হিসেবে কাজ করবে এই বিমানবন্দর। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর, বেলুচিস্তানের সম্পদ সমৃদ্ধ এলাকায় অবস্থিত।
বিদ্রোহ ও সামরিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আটকে গওয়াদার
সিপিইসি প্রকল্প বেলুচিস্তানে দশকের পর দশক ধরে চলা বিদ্রোহকে আরও জোরদার করেছে। স্থানীয় জনগণ অভিযোগ করে যে তাদের প্রাকৃতিক সম্পদের শোষণ করা হচ্ছে, অথচ তারা উন্নয়নের সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
পাকিস্তান সরকার চীনের বিনিয়োগ সুরক্ষিত রাখতে গওয়াদারে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে। শহরজুড়ে চেকপয়েন্ট, কাঁটাতারের বেড়া, সশস্ত্র প্রহরী, ব্যারিকেড এবং ওয়াচটাওয়ার রয়েছে।
স্বাধীনতাকামী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কারণে বরাবরই সহিংসতাপ্রবণ এই প্রদেশ। গোয়াদর এলাকাটি কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এখানে যেই আসে, তার ওপর কড়া নজর থাকে পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের।
স্থানীয় জনগণের অসন্তোষ ও স্মৃতিচারণ
বেলুচিস্তানের জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বেলুচের সাধারণ মানুষ বরাবরই বলে আসছে, সরকারের পক্ষ থেকে তারা বৈষম্যের স্বীকার। এই বিমানবন্দরের কোনো কাজেই স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করা হয়নি।
৭৬ বছর বয়সী গওয়াদার একজন অধিবাসী মি. বক্স জানান, “আগে আমাদের কে কোথায় যাচ্ছি, কী করছি, নাম কী— এসব জিজ্ঞাসা করা হতো না। আমরা নির্ভয়ে পাহাড়ে পিকনিকে যেতাম। এখন আমাদের পরিচয় প্রমাণ করতে হয়।”
বক্স আরও জানান, একসময় গওয়াদারে পর্যাপ্ত খাবার ও পানীয় জল ছিল, কিন্তু এখন খরা ও অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে সেই সবকিছুই ফুরিয়ে গেছে। কর্মসংস্থানও সংকুচিত হয়েছে।
গোয়াদরের স্থানীয় একজন বলেন, 'উন্নয়ন প্রকল্প তাদের কোন কাজে আসছে না। মানুষ কাজ পাচ্ছে না। বন্দর আছে, কিন্তু কাজে আসছে না। অবকাঠামো প্রকল্পে স্থানীয়দের কাজের ব্যবস্থা করা উচিত।'
এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, গোয়াদর যখন ওমানের অংশ ছিল, এখানে যাত্রীবাহী জাহাজ নোঙর করত, পরে এখান থেকে ভারতে যেত। মানুষকে না খেয়ে থাকতে হয়নি। এখন খাবার আর পানির সংকট চরমে।
চীনের উপস্থিতি থেকে স্থানীয়দের লাভ নেই
গওয়াদারের বাসিন্দারা চীনের বিনিয়োগ থেকে খুব কমই উপকৃত হয়েছেন। সরকার দাবি করে সিপিইসি প্রকল্পে ২,০০০ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু ‘স্থানীয়’ বলতে আসলে বেলুচ জনগণ নাকি দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা পাকিস্তানিদের বোঝানো হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়।
বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টির একজন নেতা জানান, “গওয়াদারের একজন বাসিন্দাও বিমানবন্দরে চাকরি পায়নি, এমনকি প্রহরী হিসেবেও নয়।”
ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক নাজাম আহমেদ বলেন, “পাকিস্তান সরকার বেলুচ জনগণকে কিছু দিতে চায় না, আর বেলুচ জনগণও সরকারের কাছ থেকে কিছু নিতে চায় না।”
গওয়াদারের মানুষদের আশা, সিপিইসি সফল হবে এবং স্থানীয় যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু বাস্তবে তা এখনও অধরাই রয়ে গেছে।
পাকিস্তানের শেষ প্রান্তে আরব সাগরের উপকূলে অবস্থিত বেলুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটায় নেই ইসলামাবাদ থেকে সরাসরি কোনো ফ্লাইট।
মূলত স্থানীয় বিদ্রোহীদের দাপাদাপির কারণেই গোয়াদরকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারছে না পাক প্রশাসন। সেখানকার নবনির্মিত বিমানবন্দরটি থেকে পাকিস্তানের বৃহত্তম শহর তথা সিন্ধ প্রদেশের রাজধানী করাচিতে যাওয়ার বিমান রয়েছে। সপ্তাহে তিন দিন এই রুটে বিমান পরিষেবা চলবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। যাত্রীর অভাবে বর্তমানে এই রুটে সপ্তাহে একদিন মিলছে পরিষেবা।
গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে বালুচিস্তানে চলছে সশস্ত্র বিদ্রোহ। অসন্তোষ দানা বাঁধার পর থেকেই দক্ষিণ-পশ্চিম প্রদেশটির হাজার হাজার যুবককে পাক গুপ্তচরেরা গুম-খুন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই সমস্ত ঘটনা সেখানকার অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বিমানবন্দরটির যাত্রী-আকর্ষণ হারানোর নেপথ্যে এই কারণটিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.