একেএম জসীম উদ্দিন
Published:2020-05-06 20:21:42 BdST
করোনা কাল ও আমাদের যাপিত জীবন
তুমি আমার প্রথম সকাল, একাকী বিকেল, ক্লান্ত দুপুরবেলা, তুমি আমার সারা দিনমান, তুমি আমার সারাবেলা। শাকিলা জাফরের এ গানের মত করোনাই এখন আমাদের সারাবেলা। আমাদের দিনরাত্রি এখন করোনাকে ঘিরেই আবর্তিত। আমরা করোনা নিয়ে জাগি, করোনা পড়ি, করোনা দেখি, করোনা নিয়েই সারাদিন থাকি এবং দিন শেষে করোনা নিয়েই ঘুমাতে যাই।
সেই যে মার্চের মাঝামাঝি থেকে শুরু আর যেন নিস্তার নেই। গোল কিছু দেখলেই মনে হয় করোনা দেখছি। ঐদিন ফেসবুকে গোল একফুলের নীচে একজন মন্তব্যে লিখেছেন দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে, মেলিছে কুসুম যেন করোনা বাহারে। আমরা কেউ বলি অদৃশ্য শত্রু, কেউ বলি গুপ্ত ঘাতক। তবে যে যাই বলি করোনার বাহাদুরি আছে বটে, তামাম বাঘা বাঘা শক্তিকে সে ইতিমধ্যেই কুপোকাত করে ছেড়েছে। আমরা শুরু থেকেই অনেককে বলতে শুনেছি করোনাকে ভয় করার কিছু নেই, এতে আতংকিত হওয়া যাবে না কিন্তু এর চালচিত্র দেখে মনে হয় করোনাকে ভয় পাওয়ারই দরকার ছিল। কারন ভয়ের নাম বাবাজী, সাপ আছে শুনলে কার বাবার হিম্মত আছে সে পথে যাবার। ভয়ের উল্টো পিঠেই সাবধানতা বা সতর্কতা! করোনা ক্ষেত্রে শতর্কতাই মূল কথা! করোনাকে তো আমরা এখনও চিনতেই পারলাম না, আমাদের নিয়ে কি খেলা খেলবে, কতদিন খেলবে, কোথায় নিয়ে ফেলবে তার কিছুই তো জানিনা! স্কুল কলেজ বন্ধ, অফিস আদালত সাটডাউন, রাস্তায় আর্মি, পুলিশের টহল, ডাক্তার নার্সরা দিনরাত খেটে যাচ্ছেন আর তাদের পরিবার পরিজন গভীর শংকায় দিন কাটাচ্ছেন। বাবার লাশ জড়িয়ে সন্তান কাঁদতে পারছে না, পাড়া পড়শি মৃতের বাড়ীর আহাজারি আর সান্তনায় যোগ না দিয়ে লাশ যেন পাড়ায় না আসে তার ব্যবস্থায় তৎপর । জানাজায় মানুষের দীর্ঘ সাড়ি নেই, দু-চার জনে জানাজা সেড়ে নিভৃতে নিথর মানুষটিকে প্যাকেট করে পরযাত্রায় পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করছেন। মসজিদে মাইকে আজান হয় ঠিকই কিন্তু বলে দেয় মসজিদে না এসে ঘরেই নামাজ পড়ুন।
কলির করোনা আমাদের যাপিত জীবনের চিরচেনা চিত্রকেই রিভার্স করে দিয়েছে। চীনের উহান থেকে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে করোনা মহাশয় ইতিমধ্যে ২১২ দেশ ঘুরে ফেলেছেন। তেড়ে মেরে ডান্ডা মেরে সবাইকে ঠান্ডা করে দিয়েছেন। মহাজাগতিক কোন কাজ কারবারই তার যেন পছন্দ নয়। তার কারনে বিশ্বে আজ অস্ত্রের ঝনঝনানি নেই, বিশ্বনেতাদের বাহাস নেই, যা আছে তাও করোনাকে নিয়ে।
জিকে শামীমদের কায়কারবার নেই, ভোল্টভরা সোনার ঝকঝকানি নেই, সম্রাটদের দহলিজ গিজগিজ সাঙ্গ-পাঙ্গর বাহাদুরি নেই, পাপিয়ার জলকেলি নেই, নেতানেত্রীদের কথার ফুলঝুরি নেই, রাস্তায় বাহারি গাড়ীর জ্যাম নেই, মার্কেট সপিংমলে বিকিকিনি নেই। ঘরে থেকে থেকে আর হাত ধুতে ধুতে সবার ত্রাহি মধুসুদন অবস্থা। গিন্নিদের কাজ উঠেছে চরমে, কর্তারা কাহিল এঘর ওঘর করে, সেলুন বন্ধ তাই ডাব্বু কালচার গেছে বেড়ে।
আগে কেউ অস্থির হয়ে উঠলে শুনতাম কুল ডাউন, এখন নতুন এক শব্দ শুনি লকডাউন, মানে সব বন্ধ। কিন্তু ফেসবুকের কল্যানে কেউ কেউ এর অন্য মানে বের করেছেন, বাঁশের নীচ দিয়ে মাথা ডাউন করে যাওয়ার নামই নাকি লক ডাউন। তবে এ ব্যবস্থা আর মনে হয় বেশিদিন টিকবে না। থাকবো নাকো বন্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎটাকে এ দামামা ইতোমধ্যই বেজে উঠেছে। মানুষ আর ঘরে থাকতে চাইছে না। কলকারকানা সাটডাউন, দোকান পাট বন্ধ, গাড়ীর পেঁ পো নেই, রাস্তায় ধুলা বালি নেই, ফুটপাথে গা গিজগিজ মানুষ নেই, ফেরিওয়ালার হাঁকডাক নেই। এভাবে কি আমরা থাকতে পারি। রমজানের ব্যবসা বানিজ্যের খবর নেই, স্বল্প আয়ীদের রোজগার নেই, শ্রমিকদের কাজ নেই, গাঁটে টেকা নেই। সবচেয়ে বড় কথা পেটের ভাতের যোগাড় নেই, প্রায় দুই মাস ঘর বসা, এভাবে কাঁহাতক আর পারা যায়। তবে রঙ্গ করে যাই বলি অবস্থা কিন্তু ভালো না। তথাকথিত ফার্স্ট দেশের তুলনায় আমাদের হেরে যাওয়া মানুষদের সংখ্যা কম হলেও মৃত্যুতো মৃত্যুই।
তবে কানাঘুষা আছে আমাদের রেকর্ডেড সংখ্যার চাইতে প্রকৃত সংখ্যা নাকি আরও বেশী। কারণ করোনা উপসর্গ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে যারা মারা যাচ্ছেন তারা এ সংখ্যায় অর্ন্তভুক্ত নন। গবেষক অনুপম সৈকত বলছেন গত ৮ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত করোনা উপর্সগে মৃত্যুর ঘটনা ৩৮৬।
সারা বিশ্বের অত্যাধুনিক দেশগুলোর মৃত্যুর মিছিল দেখে আমরা ভয়ে শিউরি উঠি, শংকিত হই এই ভেবে আমরা পারবোতো? মাত্রই না উন্নয়নের মহাসড়কে উঠে দাড়ালাম, গিয়ার বাড়ানোর সময়ে এ কোন ধাক্কা, আমরা সামলাতে পারবোতো? যেখানে পুরো বিশ্ব সংসারের অর্থনীতির খোলনোলচে বদলে যাওয়ার অবস্থা, আমরা তাল মিলাতে পারবোতো? বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদরা বড় বড় প্রেডিকশান, ইকুইশন হাজির করছেন। বিশ্ব সংস্থাগুলো বিভিন্ন সাবধান বাণী উচ্চারণ করছেন।
আমাদের সরকারকে ধন্যবাদ। সরকার তার সাধ্যমত চেষ্টা করছেন। সরকারপ্রধান বার বার টেলিভিশনে হাজির হচ্ছেন। জেলা পর্যায়ের কর্তাদের সাথে মতবিনিময় করছেন, বিভিন্ন নির্দেশনা দিচ্ছেন, বড় বড় প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। আমরা ছা পোষা মানুষ ছাই বুঝি এ সবের। কিন্তু ভাবে সাবে বুঝি সময় খারাপ। তবু সাহস হারাতে মন চায় না, আমরা না সাহসী বীরের জাতি।
বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে এক ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছাস আমাদের নিত্য সংগী। আমরা সমস্যায় পড়েছি, ক্রান্তিকাল পার করে আবার ঘুরে দাড়িয়েছি। না হয় তেমনি এক ক্রান্তিকাল আবারও আমাদের দুয়ারে। এ বিশ্বাস আমাদের রাখতে হবে যে এ ক্রান্তিকালও আমরা র্ধৈয্য ও সাহসিকতার সাথে সবাই মিলে মোকাবেলা করতে পারবো। করোনা ভাইরাস সারাবিশ্বেই ব্যপক ধংসাত্বকভাবে হানা দিয়েছে। মৃত্যুর তালিকা দিনদিনই লম্বা হচ্ছে। বাংলাদেশও ক্রমান্বয়ে ভয়াবহতার দিকে এগুচ্ছে। এটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নাই, বুক চিতিয়ে দাড়িয়েই একে মোকাবেলা করতে হবে। প্রতিদিনের করোনা তথ্য দেখে শুনে মনে হয় আমরা ভালোই করছি। তবে ডাল মে কুচ কালা না থাকলেই স্বস্তি।
আমি উন্নয়ন কর্মী সুতরাং শীবের গীত কিছুটা না গাইলে পেশার সাথে অন্যায় আচরণ করা হবে। বলতে দ্বিধা নেই বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওরা দেশের অভ্যুদয়ের পর থেকেই সরকারের পাশাপাশি সকল দুর্যোগ মোকাবেলায় জণগনের পাশে ছিল, করোনা কালেও আছে। আমরা ঢাক-ঢোলে বিশ্বাসী নই। দেশের প্রয়োজনে, মানুষের কল্যানে নামতে আমরা কারও ঘোষনার অপেক্ষায় কখনও থাকিনি, থাকিও না, এই যে সাম্প্রতিককালে রোহিঙ্গারা নাফ নদী বেয়ে দেশে আসলো, আমরা কি কারও জন্য অপেক্ষা করেছি? করিনি, আমাদের যার যা সামর্থ্য ছিল তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। বাংলাদেশে করোনা কালের শুরু থেকেই আমরা কাজে আছি। আমরা সরকারের সাথে ছিলাম এবারও তাই আছি। তবে এবারের ব্যপারটা একটু ভিন্ন এ অর্থে যে এবার নিজের ব্যাক্তিগত সেইফটি -সিকিউরিটির বিষয়টি সবার আগে ভাবতে হচ্ছে। আমরা সারাজীবন নিজের জন্য খুব একটা ভাবিনি, আমাদের ভাবনা জুঁড়ে সবসময়ই ছিল বাংলার খেটে খাওয়া মানুষ, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠি। এ ক্রান্তিকালেও তারাই সবচেয়ে ঝুঁকির্পূণ। তাই নিজেদের পাশাপাশি তাদের কথাও আমাদের ভাবতে হচ্ছে। করোনা বা কোভিড ১৯ এর ক্ষেত্রে সবেচেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা ও ব্যাক্তিগত পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা, যেটি আমরা সারাজীবনই সফলতার সাথে করে এসেছি।
যেহেতু ঘর থেকে বের হওয়া মানা, তাই স্টিয়ারিং খোদ সরকারের হাতে। সরকার সর্বোচ্চ সামর্থ্য এবং আন্তরিকতা দিয়েই চেষ্টা করছে, এতে কোন সন্দেহ নেই। বিভিন্ন নির্দেশনা ও বিধি বিধান দিয়ে পরিস্থিতি আয়ত্বে আনার চেষ্টা করছে, আবশ্যিক ভাবেই বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে। এসব বাস্তবায়নে আমাদের নিজেদের যেমন সচেতন থাকতে হবে তেমনি আমাদের প্রিয়জনদের ভালো রাখার চেষ্টাও করতে হবে। করোনা ধর্ম, বর্ণ গোত্র, ধনী, গরিব, ভৌগলিক সীমারেখা সবকিছুকে এক করে দিয়ে আবারও আমাদের যুথবদ্ধ করেছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে এ যুদ্ধেও মানুষেরই জয় হবে, মানবতাই জয়ী হবে। আসুন আমরা সবাই র্ধৈয্য ও সাহসিকতার সাথে এ যুদ্ধে নিজেদের যার যার অবস্থান থেকে অংশগ্রহণ করি, মহান সৃষ্টিকর্তা এ পরিস্থিতি থেকে যে শিক্ষা আমাদের দিতে চান তা গ্রহণ করি এবং সামনে এগিয়ে চলার পথ খুজে নিই।
আগেই বলেছি করোনা বা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সর্তকতাই আসল কথা। তাই একটি গল্প দিয়ে শেষ করি, এক অন্ধ রাতের বেলা হারিকেন নিয়ে পথ চলছেন, পথে এক লোক পথ আগলে বললো তুমি অন্ধ মানুষ, তোমার কাছে রাত দিন সবই অন্ধকার, তোমার হারিকেনের কি দরকার? অন্ধ বললো ভাইরে, আমার উপরে যেন কেউ এসে না পড়ে তাই এই ব্যবস্থা, সতর্কতা আরকি!
সুতরাং নিজে সতর্ক থাকাই মূল কথা। নিজে সতর্ক থাকুন, নিচে বাঁচুন পরিবার পরিজনকেও বাঁচান।
লেখক একজন উন্নয়নকর্মী এবং পরিচালক, এডাব
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.