সামি
Published:2020-06-23 02:16:22 BdST
ব্যর্থতার দায়ে সরে যেতে হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেস্বাস্থ্যখাতের গডফাদার মিঠুর আমলনামা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত বর্তমান সময়ে একেবারে ধসে পড়েছে বর্তমানে এই করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতে এই অবস্থা ভোগাচ্ছে সাধারণ মানুষকে অতীতে লাগামহীন দুর্নীতি লুটপাট জালিয়াতি এগুলোর মাধ্যমে স্বাস্থ্য বর্তমান সমাজ ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছে তবে যারা এই অবস্থার জন্য প্রকৃত দায়ী তারা অনেক সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে অপরাধী হয়েও তারা থাকছে না অপরাধীদের তালিকায়। এদের সঠিক বিচার না হওয়ায় পার পেয়ে যাচ্ছে তারা
ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। দেশের স্বাস্থ্য খাতে মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত তিনি। তার লাগামহীন দুর্নীতি ও জালিয়াতির তদন্ত মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কোনভাবেই থামছেই না তার দৌরাত্ম্য।
অন্যদিকে মহামারী আকার ধারন করা করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একের পর এক ব্যর্থতা, দায়িত্বহীনতা আর অযোগ্যতার কারণে শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।
ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে সরকারের একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।
দুই বছরের চুক্তিতে থাকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই ডিজির চুক্তি বাতিলের প্রক্রিয়া আগামীকাল থেকেই শুরু হতে পারে বলে সরকারের ওই সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের অন্যতম নীতি নির্ধারক ওবায়দুল কাদের করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় ও অধিদপ্তরের কার্যক্রমে বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছেন যে, "স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বি’রুদ্ধে অনেক অ’ভিযোগ এবং জনগণের বির’ক্তি বাড়ছে। সরকার বিষয়টি নিয়ে মুখ বুঝে থাকতে পারে না।"
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, করোনা শুরুর পর থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যক্রমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছিল।
আরো আগেই তাকে সরিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে সময় করোনায় আক্রান্ত হলে মানবিক কারণে তাকে তার পদে রাখা হয়।
একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ইতিমধ্যেই একজন নতুন পরিচালক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে।
সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক স্বাস্থ্য খাতে নানা অনিয়মের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তপূর্বক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করেছেন।
একই সাথে স্বাস্থ্যখাতের অন্যতম গডফাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর কে আইনের আওতায় আনা জরুরি বলে তারা দাবি করেছেন।
তাদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেছেন যে, মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুকে আশ্রয় দেওয়ার মতো একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে।
তাদের মতে, দূদকের সুপারিশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ ঘোষিত ‘কালো তালিকাভুক্ত ১৪ ঠিকাদারের’ মধ্যে তার নাম নেই। যা সন্দেহের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
চুনোপুঁটিদের ‘কালো তালিকায়’ রেখে কার ছত্রছায়ায় বারবার বেঁচে যাচ্ছেন মিঠু তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
তাই মিঠুর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে একটি শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন বলেও সুপারিশ করেছেন সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক।
কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) বিদায়ী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদউল্লাহ গত ৩০ মে জনপ্রশাসন সচিবের কাছে লেখা এক চিঠিতে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির কিছু তথ্য তুলে ধরেন। তাতে তিনি স্পষ্টভাবেই ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর নাম উল্লেখ করেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে ঠিকাদার মিঠু কীভাবে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন সেই তথ্যও চিঠিতে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) বিদায়ী পরিচালক।
মিঠুর লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ এবং টেকনোক্র্যাট লিমিটেড নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের প্রায় ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেও কোটি কোটি টাকার বিল তুলে নেওয়ার অসংখ্য ঘটনাও ঘটেছে।
বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে যে, নির্দিষ্ট সময়ে সম্পদের হিসাব না দেওয়ায় ২০১৬ সালে মিঠুর বিরুদ্ধে ‘নন সাবমিশন’ মামলা করেছিল দূদক। স্বাস্থ্যখাতে মিঠুর যাবতীয় কর্মকান্ড ও তার নামে-বেনামে থাকা ১৬টি প্রতিষ্ঠানের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে চিঠিও পাঠানো হয়।
প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে মিঠুকে তার সহায়-সম্পদের বিবরণ দাখিল করতে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এরপর রহস্যজনক কারণে তদন্তের ধারাবাহিকতা থেমে যায়। কিন্তু থামেনি মিঠু সিন্ডিকেটের লুটপাটের দৌরাত্ম্য। বরং প্রভাবশালী কর্মকর্তারা তার সিন্ডিকেটের নতুন সদস্য হয়েছেন।

নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী
সম্প্রতি নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীও দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘মিঠু সিন্ডিকেটের’ বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। সরকারের কাছে 'মিঠু সিন্ডিকেট' ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন যে, "আমার জানামতে বাংলাদেশের তিন-চারটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রায় ১০ লাখ কিট এনে রেখেছে। কিন্তু তারা তা দিতে পারছে না মিঠু সিন্ডিকেটের কারণে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘মিঠু সিন্ডিকেট’ যতক্ষণ পর্যন্ত ভাঙা না যাবে, ততক্ষণ এই মন্ত্রণালয় কখনো ভালো থাকবে না।"
কে এই মিঠু?
মিঠু সিন্ডিকেট গঠিত হয় ১৯৯১ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে মিঠু সিন্ডিকেট আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে।
গত এক যুগ ধরেই স্বাস্থ্য খাতে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে মিঠু ও তার সিন্ডিকেট। বিগত মহাজোট সরকারের আমলে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হকসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সিন্ডিকেট করে স্বাস্থ্য খাতে একচেটিয়া রাজত্ব করেন আলোচিত এই ঠিকাদার।
মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু সিন্ডিকেট টানা বছরের পর বছর ধরে গোটা স্বাস্থ্য খাতে শক্ত জাল বিস্তার করে আছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিএমএসডি, স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরো, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ওষুধ প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, নার্সিং অধিদফতর, প্রতিটি মেডিকেল কলেজ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানসমূহে আছে মিঠুর বিশ্বস্ত এজেন্ট। এসব এজেন্টই মিঠুর হয়ে যাবতীয় কর্মকান্ড সম্পাদন করে থাকে।
কখনো উপরের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রভাব খাটানো হয়, কখনো অর্থের লেনদেনে ম্যানেজ করা হয়। দেশের বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল অর্থ পাচার করেছেন মিঠু। গড়ে তুলেছেন বিত্ত-বৈভব।
মিঠুর গ্রামের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর ইউনিয়নে। তিনি বেশির ভাগ সময় বিদেশে থাকলেও তার ইঙ্গিতেই চলে স্বাস্থ্য খাত।
অনেক মন্ত্রী-সচিব মিঠুর ‘বিজনেস পার্টনার’ হিসেবে পরিচিত।
জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের তিন জন পরিচালক মিঠু সিন্ডিকেটের সদস্য। এরা তাকে সহযোগিতা করেন। তাদের একজন অবসরে চলে গেছেন। মিঠু সিন্ডিকেটের স্থায়ী সদস্য হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়োজিত আছেন একজন সহকারী সচিব। তিনি ইতিপূর্বে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ছিলেন। সহকারী সচিব পদে পদোন্নতির পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একই শাখায় পদ দখল করে রেখেছেন তিনি। তাকে অন্য কোথাও বদলি করা যায় না। মন্ত্রণালয়ে মিঠুর হয়ে সব দেখভাল করেন এই সহকারী সচিব।
এছাড়া স্বাস্থ্য খাতের নিচের পর্যায়ের বিভিন্ন পদে মিঠু সিন্ডিকেটের কিছু স্থায়ী সদস্যও আছে। নিচের পর্যায়ের পদ হলেও এরা প্রত্যেকেই মিঠুর বদৌলতে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী বলে পরিচিত।
স্বাস্থ্য অধিদফতরে মিঠু সিন্ডিকেটের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আবজাল দম্পত্তি ১৫ হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ারও চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। মাফিয়া মিঠুর দুর্নীতির সহযোগী আবজালের সূত্র ধরেই স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন ইউনিটের ৪৭ জন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যাপারেও তদন্ত চালায় দুদক।
এদের মধ্যে প্রথম দফায় পরিচালক (চিকিৎসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি) ডা. আবদুর রশীদ, পরিচালক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন, সহকারী পরিচালক (বাজেট) ডা. আনিসুর রহমান ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আফজাল হোসেনকে দুদকে তলব করা হয়।
দ্বিতীয় দফায় ডাকা হয় আরও পাঁচজনকে। তারা হলেন, ফরিদপুর টিবি হাসপাতালের ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট বেলায়েত হোসেন, জাতীয় অ্যাজমা সেন্টারের হিসাবরক্ষক লিয়াকত হোসেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক রাকিবুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অধিদফতরের উচ্চমান সহকারী বুলবুল ইসলাম ও খুলনা মেডিকেল কলেজের অফিস সহকারী শরিফুল ইসলাম। তারা সবাই শীর্ষ মাফিয়া মিঠুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবেই পরিচিত।
খুলনা শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের একজন উচ্চমান সহকারীও মিঠু সিন্ডিকেটের কল্যাণে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকেরই দেশ-বিদেশে একাধিক বাড়ি রয়েছে। একই সঙ্গে তারা নামে-বেনামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খুলে স্বাস্থ্য খাতে যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.