বিশেষ প্রতিবেদক
Published:2023-05-11 04:04:28 BdST
গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলীর ক্ষমতা সীমিত করছে মন্ত্রণালয়
গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি সরকারকে নিজ দেশের জনগনের সুবিধার্তে অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হয়। এক্ষেত্রে অধিকাংশ উন্নয়নকাজই গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে থাকে সরকার।
সরকারের গৃহীত ডেল্টা প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য অন্যতম একটি কর্মসূচী হলো টেকসই উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে অবকাঠামো ও নির্মান খাত। আর এই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো বাস্তবায়নে মূখ্য ভূমিকা পালন করে গনপূর্ত অধিদপ্তর।
সম্প্রতি, গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বদলি বা পদায়নে শৃঙ্খলা আনতে নীতিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে গৃহায়ন ও গনপূর্ত মন্ত্রণালয়। এই নীতিমালা প্রনয়ন করতে যেয়ে প্রধান প্রকৌশলীর কাছ থেকে গ্রেড-৫ বা নির্বাহী প্রকৌশলীর বদলির ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এটা কার্যকর হলে মাঠপর্যায়ের কাজের সমন্বয়, বাস্তবায়ন ও নিয়ন্ত্রণে বড় ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, গণপূর্তের বদলি বা পদায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম রয়েছে এটা সত্য। তেমনি এটাও সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৌশলীগন ঘুষ গ্রহন, দুর্নীতি ও নানাবিধ অনিয়ম করে থাকেন যার ফলশ্রুতিতে সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি হয়, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয় এবং তার ফলস্বরূপ সরকারের ব্যয় বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীকে কঠোর হতে হয় তার অধীনস্থদের নিয়ন্ত্রণ করতে। আর যখনই তিনি কঠোর হবেন, তখনই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীরা অধিদপ্তরকে পাশ কাটিয়ে মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে নিজের আখের গুছিয়ে নিবে।
অন্যদিকে, নির্বাহী প্রকৌশলীরাই মূলত মাঠ পর্যায়ে সরকারের গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নে মূখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে প্রধান প্রকৌশলীর স্পষ্ট ধারনা থাকে যে, কাকে কোথায় রাখলে কাজ ভালো হবে। আবার কেউ যদি অনিয়ম করে সেক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাও প্রধান প্রকৌশলীর হাতে থাকা যুক্তিযুক্ত। এজন্য নীতিমালা করে নির্বাহী প্রকৌশলীদের বদলির ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া কোনো বিবেচনায় সঠিক হবে না।
মন্ত্রনালয় যখন অধিদপ্তরের স্বাভাবিক কর্মকান্ডে হস্তক্ষেপ করবে তখন চেইন অব কমান্ড লংঘিত হবে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, অধিদপ্তরের কর্মরত সবাই মন্ত্রণালয়কে খুশি করার চেষ্টা করবে। এতে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড বাধাগ্রস্ত হবে।
তাই মন্ত্রণালয়ের খসড়া নীতিমালায় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকলে সেখান থেকে সরে এসে পূর্বের অবস্থা বজায় রাখা শ্রেয় বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
জানা যায়, গত ২০ ডিসেম্বর গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অধিশাখা-১ থেকে জারিকৃত অফিস আদেশে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর সব বদলি বা পদায়নের ক্ষমতা স্থগিত করা হয়।
ওই আদেশে বলা হয়, সম্প্রতি গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা হয়রানিমূলক বদলিসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়গুলো বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সমন্বয়হীনভাবে বদলি করায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। সেই থেকে বদলি বা পদায়ন বন্ধ ঝুলে রয়েছে। তবে এ সময়ে জরুরি প্রয়োজনে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গুটিকয়েক বদলি বা পদায়ন করেছে অধিদপ্তর।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীদের বদলি করা নিয়ে নিজ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পর্কের ফাটল ধরে গনপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারের। সেই সূত্রেই অধিদপ্তরে সৃষ্ট উত্তেজনা প্রশমন ও সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলা এড়াতেই একটি নীতিমালা প্রনয়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে গনপূর্ত মন্ত্রনালয়।
নীতিমালায় যা যা থাকছে
বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, সরকারি চাকরি আইনের ১১ নম্বর ধারা এবং রুলস অব বিজনেস-১৯৯৬-এর রুলস ৪(৯)(এ) এর ক্ষমতাবলে সরকার গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মচারীদের সুষ্ঠুভাবে পদায়নের লক্ষ্যে এই নীতিমালা প্রণয়ন করছে। এই নীতিমালা ‘গণপূর্ত অধিপ্তরের কর্মচারীদের বদলি বা পদায়ন নীতিমালা-২০২৩’ নামে অভিহিত হবে।
উক্ত নীতিমালায় ৬টি ধারা এবং ২০টি উপধারা রাখা হয়েছে। এই নীতিমালার ৪-এর ১ উপধারা নিয়েই মূলত আপত্তি উঠেছে। সেখানে বলা হয়েছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের গ্রেড-৫ ও তদূর্ধ্ব পদে বদলি বা পদায়ন মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত থাকবে। অন্য গ্রেডেরগুলো গণপূর্ত অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত থাকবে।
একাধিক জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞের মতে, গণপূর্তে গ্রেড-৫ বা নির্বাহী প্রকৌশলীরা মাঠপর্যায়ের কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এই সংস্থার প্রধান প্রকৌশলীই ভালো জানেন, কাকে কোথায় রাখলে কাজ ভালো হবে। এজন্য এই ক্ষমতা প্রধান প্রকৌশলীর হাতে থাকা যুক্তিযুক্ত।
তাদের মতে, মন্ত্রণালয় নীতিমালা করে প্রধান প্রকৌশলীর কাছ থেকে নির্বাহী প্রকৌশলীর ক্ষমতা কেড়ে নিলে নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় করতে খুব অসুবিধা হবে। মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা।
নীতিমালার প্রথম ধারা মূলত শিরোনাম ও প্রয়োগ প্রসঙ্গে। এখানে ক-তে বলা হয়েছে, এ নীতিমালা গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মচারীগণের বদলি/পদায়ন নীতিমালা ২০২৩ নামে অভিহিত হবে। এ ধারার খ-তে বলা হয়েছে, এই নীতিমালা গণপূর্ত অধিদপ্তরের ১০ গ্রেড এবং তদূর্ধ্ব পর্যায়ের কর্মচারীদের বদলি/পদায়নের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। গ-তে বলা হয়েছে, এই নীতিমালা অবিলম্বে কার্যকর হবে।
ধারা-২-এ নীতিমালার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ধারা-৩-এ বলা হয়েছে, বিসিএস (গণপূর্ত) ক্যাডার এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের ১০ গ্রেডের নন-ক্যাডার কর্মচারীদের বদলি বা পদায়নের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।
৩-এর ১-এ বলা হয়েছে, কর্মচারীদের জ্যেষ্ঠতা, কর্মদক্ষতা, সততা, কাজের অভিজ্ঞতা এবং বিগত বছরের চাকরির বৃত্তান্ত বিবেচনায় পদায়ন করা হবে।
৩-এর ২-এ বলা হয়েছে, মাঠপর্যায়ের পদায়নের ক্ষেত্রে একই জেলায় একই পদে স্বল্পবিরতিতে দুই মেয়াদে পদায়ন করা যাবে না। তবে বিশেষায়িত পদসমূহে অর্থাৎ প্রকল্প প্রণয়ন, কাঠামোগত, ইলেকট্রিক্যাল, প্লাম্বিং নকশা প্রণয়ন, পিঅ্যান্ডডিসহ বিভিন্ন নকশা প্রণয়নে কর্মরতদের ক্ষেত্রে পদায়নের মেয়াদ শিথিলযোগ্য।
৩-এর ৩-এ বলা হয়েছে, বিভাগীয় শহর ছাড়া কোনো কর্মচারীকে নিজ জেলায় পদায়ন করা যাবে না।
৩-এর ৪ ধারায় বলা হয়েছে, কাউকে একাধিক প্রকল্পের পরিচালক করা যাবে না।
৩-এর ৫-এ বলা হয়েছে, পার্বত্য বা দুর্গম এলাকায় কর্মচারীর চাকরিকালীন সময় হবে সর্বোচ্চ দুই বছর। তবে চাকরির জীবনে এটা চার বছরের বেশি হবে না।
৩-এর ৬-এ বলা হয়েছে, একই কর্মস্থলে দুই বছর হলে ওই কর্মচারী বদলিযোগ্য হবেন। আর একই কর্মস্থলে তিন বছরের বেশি সময় রাখা যাবে না।
৩-এর ৭-এ বলা হয়েছে, কোনো কর্মচারীর স্ত্রী বা স্বামী উভয়ে চাকরিজীবী হলে একই কর্মস্থলে বা যথাসম্ভব নিকটবর্তী কর্মস্থলে পদায়নের বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে।
৫-এর ক-তে বলা হয়েছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের জোন, সার্কেল, বিভাগ ও উপবিভাগসমূহকে কাজের পরিধি, প্রকৃতি, গুরুত্ব, রাজধানী, বিভাগ, জেলা শহর থেকে দূরত্ব বিবেচনায় তিনটি শ্রেণিতে অর্থাৎ-ক, খ ও গ শ্রেণিতে বিন্যাস্ত করা হবে।
সবশেষ ধারা-৬-এর ১-এ বলা হয়েছে, এ নীতিমালার কোনো অনুচ্ছেদের বিষয়ে কোনো অস্পষ্টতা পরিলক্ষিত হলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা বা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.