বিশেষ সংবাদদাতা :
Published:2024-03-11 12:29:57 BdST
চাকরিচ্যুত হয়েও আমজাদ ‘ট্রেড নেতা‘ মানিঅর্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে গড়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ
চাকরি চলে গেছে বছর ৩ বছর আগে। তবুও তিনি নেতা। শ্রম আইনে একটি প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ ৩টি ইউনিয়ন থাকার কথা বলা হলেও তিনি চতুর্থ ইউনিয়নের স্বঘোষিত ‘সাধারণ সম্পাদক‘। এ ছাড়া রয়েছে অর্থ আত্মসাত, জাল-জালিয়াতি এবং বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলা। এ হেন পরাক্রমশালী ব্যক্তিটি আর কেউ নন। তিনি ‘বাংলাদেশ পোস্টম্যান ও ডাক কর্মচারি ইউনিয়ন‘র সাধারণ সম্পাদক মো: আমজাদ আলী খান। এ নাম লিখে গুগলে সার্চ দিলেই কখনো মিলবে র্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃত হ্যান্ডকাফ পরা ছবি। কখনো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কোনো মন্ত্রীর গলায় পরাচ্ছেন গাদা ফুলের মালা। মূলত: সরকারদলীয় শ্রমিক সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে তিনি ডাক বিভাগে এখনো ফলিয়ে চলেছেন নেতৃত্ব। যদিও রেকর্ডপত্র বলছে, ২০০৬ সালে প্রণীত ‘শ্রম আইন‘ এবং ‘বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা-২০১৫‘ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আইনের ১৭৯ (৫) ধারা অনুযায়ী একটি প্রতিষ্ঠানে ৩টি‘র বেশি রেজিস্ট্রার্ড ট্রেড ইউনিয়ন থাকতে পারে না। যদি থাকে সেটি ২০১৫ সালের শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ ডাক বিভাগে এখন ট্রেড ইউনিয়ন আছে ৪টি। আইন-কানুনের তোয়াক্কা নেই। ধার ধারছেন না বিধি-বিধান। আমজাদ আলী খান নিজেই যেন আইন। সংগঠন নিয়ে তিনি যা ভাবেন সেটিই বিধি। কখন এটির নির্বাচন হয়, কখন গঠিত হয় কমিটি-সংগঠনের সাধারণ সদস্যরা সেটি জানতেও পারেন না। মো: আবুর হাশেম খান খাদেমকে ‘সভাপতি‘ রেখে নিজে বসে যান ‘সাধারণ সম্পাদক‘র চেয়ারে। প্রশ্ন করারও সাহস নেই কারো।
রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, জাল-জালিয়াতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে ২০২১ সালে ২৫ নভেম্বর ডাক বিভাগ থেকে আমজাদ আলীকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তদুপরি ডাক বিভাগের বিভিন্ন বিষয়েআমজাদ আলী খান হস্তক্ষেপ করছিলেন। ডাক বিভাগের মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে (কেপিআই) তিনি অনুপ্রবেশ করতে থাকেন। এ প্রেক্ষাপটে তার অনুপ্রবেশে ডাক বিভাগের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে-এমন আশঙ্কা ব্যক্ত করে গতবছর জুলাই মাসে ঢাকা জিপিওসহ ডাক অধিদফতরে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ঢাকা মেট্রো সার্কেল, অতিরিক্ত পোস্টমাস্টার জেনারেল খান হাসান মোহাম্মদ ইকবাল মাসুদ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনারের কাছে সহযোগিতা চান।
তিনি এখন আর ডাক বিভাগের কর্মচারিই নন। কিন্তু শ্রম অধিদফতরের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারির সঙ্গে আঁতাত করে তিনি ট্রেড ইউনিয়ন করছেন। অথচ শ্রম আইন-২০০৬ এর ১৮০ ধারায় বলা হয়েছে ‘(১) কোনো ট্রেড ইউনিয়নের গঠনতন্ত্রে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তি উহার কর্মকর্তা অথবা সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বা থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি- (ক) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া থাকেন, অথবা ধারা ১৯৬ (২) (ঘ) অথবা ধারা ২৯৮ এর অধীন কোনো অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হইয়া থাকেন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর দুই বছর কাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে।‘ (খ) যে প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা হইয়াছে সেই প্রতিষ্ঠানে তিনি শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত বা কর্মরত না থাকেন; তবে শর্ত থাকে যে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সেক্টরের ক্ষেত্রে ইউনিয়নের সদস্যরা ইচ্ছা পোষণ করিলে ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী কমিটি মোট কর্মকর্তার শতকরা দশ ভাগকে নির্বাচিত করিতে পারিবে, যাহারা উক্ত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নয়‘।
নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছর ৭ নভেম্বর আমজাদ আলী খানের ‘বাংলাদেশ পোস্টম্যান ও ডাক কর্মচারি ইউনিয়ন ( রেজি: নং-২১২৯) এর কার্যকরি কমিটির কার্যকরিতা ও নির্বাচন শ্রম অধিদফতর স্থগিত করা (স্মারক নং-৪০.০২.০০০০.০৩৪-৪৮.১১৮) হয়েছে। আদেশ দেয়া হয়েছে শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালকের মাধ্যমে অবাধ সুষ্ঠু ও সকলের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে ইউনিয়নের নির্বাচন অনুষ্ঠানের। আমজাদ আলী খান তার কিছুই করেন নি।
জালিয়াতি ও অবৈধ সম্পদ : মানি অর্ডার জালিয়াতি আর দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি গড়ে তুলেছেন বিপুল অবৈধ সম্পদ। যা এখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান করছে। ৩ কোটি টাকার মানি অর্ডারের নথি জালিয়াতির ঘটনায় ২০২১ সালে আমজাদ আলী খানসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা (মেট্টো বিশেষ মামলা নং-১০/২০২১) করে খোদ ডাক বিভাগ। আদালত মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয় দুদককে। কিন্তু প্রভাবশালী আমজাদ প্রভাব খাটিয়ে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন। এ মামলায় সহযোগী মোস্তাফিজুর রহমান, ডলি রাণী সাহা, লিংকন সাহা, আশরাফ ও শিমুসহ র্যাব গ্রেফতার করে আমজাদকে। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পান। যদিও অপরাধপ্রবণ আমজাদের কারাভোগ এটিই প্রথম নয়। কুষ্টিয়ার ঝিলপাড়া লাইন এলাকার রজব আলী খানের পুত্র আমজাদ আলী খান পোস্টম্যান হিসেবে চাকরি পান ১৯৮৭ সালে। চাকরি লাভের দুই বছরের মাথায় তিনি হত্যা মামলার আসামি হন। বহু তদবিরে এ মামলা থেকে তিনি নিষ্কৃতি পান। ১৯৯৪ সালে তিনি পোস্টম্যান থেকে পোস্টাল অপারেটর হিসেবে পদোন্নতি পান। এ পদে বসেও তিনি জাল-জালিয়াতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এ কারণে তাকে ২০০১ সালে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ২০০৩ সালে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। পরে তদবির করে পুনর্বহাল হন। আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিম্নপদগুলোতে নিয়োগ বাণিজ্য তার আয়ের বড় উতস। ভুয়া নিয়োগপত্রের মাধ্যমে শত শত লোককে চাকরি দেন তিনি। চাকরির নাম করে অনেকের কাছ থেকে নিয়েছেন অর্থ। এছাড়া পোস্টাল কলোনী দখলে রেখে সেগুলো ভাড়া দিয়েও তিনি অর্থ হাতিয়ে নেন। এভাবে আমজাদ আলী খান হয়েছেন বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক। সামান্য একজন পোস্টাল অপারেটর হয়েও কুষ্টিয়া সদরে দেবী প্রাসাদ চক্রবর্তী রোডের ঝিলপাড়া এলাকায় ২০ কাঠা জমির ওপর করেছেন প্রসাদোপদম অট্টালিকা। ‘গ্রীন হাউজ‘ নামের এই প্রাসাদ নির্মাণে ব্যয় করেছেন কয়েক কোটি টাকা। কুষ্টিয়ায় রয়েছে তার পরিবহন ব্যবসা। ২০টির মতো লেগুনা এবং বাস রয়েছে। ছেলে ইমরান খানকে দিয়ে তিনি এ ব্যবসা পরিচালনা করেন। রাজধানীতেও রয়েছে তার ফ্ল্যাট ও প্লট। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও দুদক,এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো রহস্যজনকভাবে তার বিষয়ে নিরব। কিন্তু কেন এই নিরবতা ? জানতে চাইলে দুদক সচিব খুরশীদা ইয়াসমিন বলেন, অনেক সময় রেকর্ডপত্র সংগ্রহে সময় লাগে। তাই তদন্ত ও অনুসন্ধান নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সম্পন্ন সম্ভব হয় না। এর অর্থ এই নয় যে, দুদক নির্বিকার।
এ ব্যাপারে আমজাদ আলী খানের সাথে বক্ত্যবের জন্য যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্য ফিন্যান্স টুডেকে বলেন যখন সংগঠন করি তখন ৩টি সংগঠন ছিল। পরবর্তীতে আরো একটি সংগঠনের অনুমোদন প্রদান করা হয়। আমরা বিধি অনুযায়ী সংগঠন পরিচালনা করছি। চাকরী সংক্রান্ত ব্যপারে তিনি বলেন আমাকে ডাক বিভাগ থেকে চাকরিচ্যুত করা আমি উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে মহামান্য আদালতে মামলা করেছি যা চলমান আছে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন শত্রুতাবশত ভাবে বিএনপির লোকেরা আমাদের ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেছে। দুদকের উক্ত মামলা চলমান আছে।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.