আবু তাহের বাপ্পা
Published:2024-10-19 19:06:20 BdST
করোনা দুর্যোগে মহালুটপাটকারী ডাঃ সেহাব ধরাছোঁয়ার বাইরে
করোনা দুর্যোগে মহালুটপাটকারী ডাঃ মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিনকে তেজগাঁও জাতীয় নাক গলা ইনস্টিিটউটে উপ-পরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়েছে। তিনি পতিত সরকার আমলে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের কেনাকাটায় ১০ গুণ বেশি দামে কিনে হাতিয়ে নেন বড় অংকের টাকা। সেহাব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ওই সময়ে দুদকে মামলা দায়ের করার পর গণভবনের মাধ্যমে তদবির করে তা ধামাচাপা দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালিন ডিজির সহযোগিতায় তিনি ছিলেন বেপরোয়া। করোনায় স্বাস্থ্যখাতের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্রয়ে বড় অনিয়ম-দুর্নীতি হলেও তা আড়ালেই থেকে গেছে। করোনার চিকিৎসায় প্রথম নিয়োজিত হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে মহালুটপাটের সেহাব সিন্ডিকেট কিভাবে দুদক থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন তার ভয়াবহ তথ্য জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই সময়ে হাসপাতালের ক্রয় কমিটিকে পাশ কাটিয়ে নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ১০ গুণ বেশি দামে নিজের শ্যালক ও ভাগ্নেকে কাজ দেন হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন। শুধু কাজ দেয়াই নয়; স্টোরে মালামাল জমা পড়ার আগেই পরিশোধ করে দেন সমস্ত বিল। করোনার সময়ে ক্রয় করা এ ধরনের ৯৩টি বিলের কারসাজির তথ্য প্রমাণের পরও তিনি কিভাবে দুদক থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে স্বাস্থ্য বিভাগে। পতিত সরকারের দোসর সেহাব উদ্দিন ১২ কোটি ১০ লাখ ৬৫ হাজার ৯০০ টাকার কার্যাদেশ দিয়ে হাতিয়ে নেন প্রায় পুরো টাকা। সেহাব সিন্ডিকেটের অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে আলোড়ন সৃস্টি হলে ভিন্ন পন্থায় ম্যানেজ করা হয়।
নিজ ক্ষমতায় ক্রয়ের নামে লুটপাট করা তত্ত্বাবধায়ক সর্বশেষ ক্রয় কমিটির দুই সদস্যকে জরুরি তলব করে পূর্বের বিভিন্ন তারিখের নামে প্রায় অর্ধ শতাধিক স্বাক্ষর নেন। সেহাবের ফাদে পড়ে স্বাক্ষর দিয়ে বিপাকে পড়েন ক্রয় কমিটির দুই সদস্য ডা. সোহেলী পারভিন ও ডা. মামুনুর রশীদ। তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছে ওই হাসপাতালের পরিচালক না থাকায় ডা. সেহাব উদ্দিন একতছত্র আধিপত্য কায়েম করে হাসপাতালে করোনার চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়া নিয়ে বিতর্কিত সাহেদের সঙ্গে কয়েকগুণ বেশি দামে চুক্তি করেন। নার্সদের নিম্নমানের খাবার দিয়ে সেখান থেকে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও উঠেছে ডা. সেহাবের বিরুদ্ধে। ডা. সেহাবের এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করে তোপের মুখে পড়ে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির তৎকালিন প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামান। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে আলীমুজ্জামানকে বদলি করা হয় বাগেরহাট সিভিল সার্জন অফিসে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, মেসার্স আলী ট্রেডার্স নামের প্রতিষ্ঠানকে ডিপিএম পদ্ধতিতে ১২ ধরণের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৩ কোটি ১৮ লাখ ৪১ হাজার ৭৫০ টাকার কার্যপত্র দেয়া হয়েছিলো। এভাবে আরও ৩টি কার্যপত্র দেয়া হয়েছে একই নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে। ৭ ধরনের যন্ত্রাপতি ক্রয়ে ১ কোটি ৪২ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ১৫ মার্চে ১১ ধরণের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ২ কোটি ৮৩ লাখ ৭ হাজার ৫শ’ টাকা এবং ২৫ মার্চে ৫ ধরণের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ১ কোটি ৪৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকার কার্যাদেশ দেয় ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন। এসব ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যয় করা হয়েছে ৮ কোটি ৯০ লাখ ৪৯ হাজার ২৫০ টাকা। কিন্তু দুদক অনুসন্ধান করে এর সততা মিললেও মোটা টাকার বিনিময়ে অনুসন্ধান টিমকে ম্যানেজ করেন সেহাব উদ্দিন। ওই সময়ে শেখ সেলিম বিষয়টি নিয়ে বেশ তৎপর হয়ে উঠেন। সেহাব উদ্দিন কোথায় কোথায় শেখ সেলিম এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের নাম ব্যবহার করতেন। যেকারণে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলো অনেকটাই ধামাচাপা পড়ে যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতিটি যন্ত্রপাতিই প্রায় ১০ গুণ বেশি দামে ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ক্রয়ের জন্য দেয়া হয়ে ছিলো। তার স্বাক্ষর করা কার্যপত্রের ৬ নম্বর তালিকায় পিসিআর মেশিনের দাম ধরা হয় ১ কোটি ৬৫ লাখ। অথচ এ মানের একটি পিসিআর মেশিনের দাম ২৫ লাখ টাকা। যা প্রায় ১০ গুণ বেশি দামে ক্রয়ের জন্য বলা হয়। একই কার্যপত্রের ৪ নম্বরে ডেফ্রিব্লেটর নামে একটি যন্ত্রের দাম ধরা হয় ৯ লাখ ৮১ হাজার অথচ এটির দাম সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা। ৫ নম্বরে সেন্ট্রাল মাল্টিপারপাস প্যাশেন্ট মনিটর নামে যন্ত্রটির দাম ধরা হয় ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অথচ এই মেশিনটির সর্বোচ্চ দাম ৮ লাখ টাকা। কার্যপত্রে যেসব দেশ ও ব্রান্ডের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সে অনুযায়ী মালামাল সরবরাহ করা হয়নি। চীন থেকে যন্ত্রপাতি ক্রয় করে বিভিন্ন দেশের স্টিকার লাগিয়ে দেয়া হয়। জিপিও নং-১৯, মহাখালী সি/এ, বনানী ঢাকা নামে প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানায় পরিদর্শন করে দেখা গেছে, মেসার্স আলী ট্রেডার্স নামে কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। মেসার্স আলী ট্রেডার্সের প্যাড ব্যবহার করে ডা. সেহাব উদ্দিনের শ্যালক জাকারিয়া এই কার্যাদেশ নিয়ে ছিলেন। প্যাডে আলী ট্রেডার্সের মালিক আলমগীরের স্বাক্ষরও নেয়া হয়নি।
ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন এসব অনিয়ম শুধু হাসপাতালের ভারী যন্ত্রপাতি ক্রয়েই সীমাবদ্ধ রাখেননি। হাসপাতালের এমএসআর/চিকিৎসা ও শৈল্য চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ক্রয়েও একই চিত্র উঠে এসেছে। ফকিরাপুলের ১২০, হাবিবুল্লাহ ম্যানশনের জি এম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে আরেক নাম সর্বস্ব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে ৩ কোটি ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬৫০ টাকার কার্যাদেশ দিয়েছেন। এসব সরঞ্জামাদি সরবরাহ না করেই ডা. সেহাব উদ্দিনের ভাগ্নে মহিউদ্দিনের প্রতিষ্ঠান জি এম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এই টাকা উঠিয়ে নিয়েছে। ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স বানিয়ে ডা. সেহাব উদ্দিন নিজেই বিভিন্ন নামে ব্যবসা করতেন। এক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন শ্যালক জাকারিয়া ও ভাগ্নে মহিউদ্দিনকে। হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিনের পীড়াপিড়ীতে বাধ্য হয়ে পূর্বের বিভিন্ন তারিখের এবং তারিখ ছাড়া বিভিন্ন কাগজে প্রায় অর্ধশতাধিক স্বাক্ষর করে বিপাকে পড়েন ক্রয় কমিটির দুই সদস্য ডা. সোহেলী পারভীন ও ডা. মামুনুর রশীদ। কি কাগজ তা পড়তেও দেননি, পড়ার সুযোগও দেননি। ৪০ থেকে ৫০টি কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া হয়। এমনকি অনেকগুলোতে তারিখ ছাড়াই স্বাক্ষর নেয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সেহাবের জালিয়াতির বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে বদলি বা অন্যভাবে সাজা প্রদান করা হতো। সেহাব উদ্দিন বদলি হওয়ার পর তার অপকর্মের বিষয়ে মুখ খুলে তথ্য দেন হাসপাতালের নার্স ও বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা।
যন্ত্রপাতি ক্রয়ে জালিয়াতি ও ক্রয় কমিটির দুই সদস্যের পূর্বের বিভিন্ন তারিখে স্বাক্ষর নেয়া প্রসঙ্গে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন, পুরোনো কাশন্তি নতুন করে আলাপের সময় নেই। আপনারা এক মুরগী কয়বার জবাই করতে চান। যান আমার বিরুদ্ধে নিউজ করেন। আমি এসব পড়েও দেখিনা। অপর এক প্রশ্নবানে তিনি বলেন, আমি দুদক থেকে দায়মুক্তি নিয়েছি। দুদকের অনুসন্ধানী টিম আমার বিরুদ্ধে কোন কিছুই পায়নি।
অভিযোগের বিষয়ে দুদক-সূত্রে জানা গেছে, ওই সময়ে ওয়ার্কশপ, সেমিনার ও প্রশিক্ষণের নামে ভুয়া বিল দেখিয়ে সাত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক (আইইএম) ড. আশরাফুন্নেছাসহ পাঁচ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। তলবকৃতদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের উপপরিচালক (পিএম) জাকিয়া আখতার ও উপপরিচালক (স্থানীয় সংগ্রহ) আবু তাহের মো. সানাউল্লাহ নূরীকে ১৩, সহকারী পরিচালক এ কে এম রোকনুজ্জামান ও গবেষণা কর্মকর্তা পীযূষ কান্তি দত্তকে ও পরিচালক (আইইএম) ড. আশরাফুন্নেছাকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের আইইএম ইউনিট ওয়ার্কশপ ও সেমিনারের নামে ভাউচার করে প্রায় ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধানের প্রয়োজনে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের রেকর্ডপত্র তলব করে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।
অভিযোগ উঠেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম ডা. সেহাবকে সার্বিক সহযোগিতা করেন। তার কারণেই সেহাব সিন্ডিকেট দুদক থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। সূত্রমতে, কুয়েত মৈত্রীর সুপারের পক্ষে একা এত বড় দুর্নীতি করা সম্ভব না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এর সঙ্গে জড়িত। যেই জড়িত থাকুক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তারা। অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, উনি একসময় সিলেট মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। সেহাব ছাত্রদলের নেতা ছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে তিনি বড় আওয়ামী লীগার ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আমিনুল হাসানের সহযোগিতায় এত বড় দুর্নীতি হয়েছে। অথচ তাকে ঢাকা বিভাগের (স্বাস্থ্য) মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়ে ছিলো। তার বিরুদ্ধে দুদক থেকে চার্জশিটও দেওয়া হয়ে ছিলো।
সূত্রমতে, করোনা দুর্যোগে মহালুটপাটকারী ডাঃ মোহাম্মদ সেহাব উদ্দিনকে তেজগাঁও জাতীয় নাক গলা ইনস্টিিটউটে উপ-পরিচালক হিসেবে বদলি করার পড় তিনি বেপরোয় হয়ে উঠেছেন। তিনি কাউকেই তোয়াক্কা করেননা। দুদকের মামলাকে থোরই কেয়ার করছেন। সর্বমহলে বলে বেড়াচ্ছেন তিনি নিদোর্ষ ছিলেন। অন্তবর্তী সরকার তাকে কাজের পুরুস্কার হিসেবে বদলি করেছে। সামনে প্রমোশন হবে তাই তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এদিকে দুদক সূত্র বলছে, ওই মামলায় যাদেরকে তলব করা হয়ে ছিলো তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এখনো তদন্ত শেষ হয়নি। তারা পতিত সরকার আমলে নানাভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে লুটপাট করে নিজেদের আখের ঘুছিয়ে এখন বাচার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। পতিত সরকার আমলে স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম দুর্নীতি হয়েছে।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.