বিশেষ প্রতিবেদক
Published:2025-05-03 20:12:34 BdST
টিকিট কেলেঙ্কারিতে জড়িত গ্যালাক্সি ইন্টারন্যাশনালসহ ৩০ ট্রাভেল এজেন্সি
সম্প্রতি সরকারি এক তদন্তে আন্তর্জাতিক ১১টি এয়ারলাইন্স, তাদের জেনারেল সেলস এজেন্ট (জিএসএ) এবং ৩০টি ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যাপক হারে টিকিট মূল্যের কারসাজি ও প্রতারণার অভিযোগ উন্মোচিত হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বিদেশগামী বাংলাদেশি শ্রমিকরা।
এই কেলেঙ্কারির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন গ্যালাক্সি ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ। তিনি সৌদিয়া, কাতার এয়ারওয়েজ, সালাম এয়ার, জাজিরা এয়ারওয়েজ, ওমান এয়ার এবং থাই এয়ারওয়েজের মতো বড় এয়ারলাইন্সের জিএসএ হিসেবে কাজ করেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে তাকে টিকিট সরবরাহ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে অন্যতম মূল ভূমিকা পালনকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় (এমওসিএটি)-এ জমা দেওয়া এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কার্যালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে যাত্রীর নাম ছাড়াই গ্রুপ বুকিংয়ের মাধ্যমে টিকিট বরাদ্দ করে তা মজুদ রাখা হতো। পরে সেগুলো হোয়াটসঅ্যাপের মতো অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে বিক্রি করা হতো দ্বিগুণ বা তিনগুণ দামে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এয়ারলাইন্সগুলো সাধারণত ট্রাভেল এজেন্টদের ৭ শতাংশ কমিশন দিয়ে থাকে। কিন্তু অনেক এজেন্সি এই নিয়ম না মেনে নিজেদের মতো বাড়তি দাম নির্ধারণ করে বিক্রি করেছে, যা একটি দুর্বলভাবে নিয়ন্ত্রিত বাজারকে কাজে লাগিয়ে করা হয়েছে।
গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে ওয়ালিদ বলেন, “কিছু ট্রাভেল এজেন্ট সুযোগ কাজে লাগিয়ে লাভবান হয়েছে। তবে এয়ারলাইন্সগুলো স্বচ্ছভাবে টিকিট বিক্রি করেছে। গ্রুপ বুকিং বিশ্বব্যাপী প্রচলিত একটি পদ্ধতি।”
কিন্তু বাস্তবে গ্যালাক্সি গ্রুপ সৌদিয়া, কাতার, জাজিরাসহ কয়েকটি মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বড় এয়ার লাইনসগুলোর জিএসএ হবার সুবাদে স্বল্প দামের টিকিটগুলো নাম ছাড়া ব্লক করে বেশী দামে বিক্রয় করে শত কোটি টাকার অবৈধ আয় করেছে ওয়ালিদ। তার গ্যালাক্সি ট্রাভেল ও গ্রুপের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান গুলো বিদেশে মানি লন্ডারিংয়ে জড়িত এবং দুবাই ও লন্ডনে শত কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট ও অন্যান্য ব্যবসা আছে মর্মে জানা যায়।
পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের ১৭ বছরে এই ওয়ালিদের উত্থান, দেশের প্রায় ৮ টি এয়ারলাইনসের জিএসএ সে এই হাসিনার আমলে প্রভাব খাটিয়ে নিয়ে নেয়। জানা যায় বেক্সিমকোর সালমান এফ রহমান তার গোপন ব্যবসায়ীক পার্টনার। এই ব্যবসার আয়ের একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগের নেতাদের পকেটে যায়, যা এখনো চলমান। বর্তমান ইউনুস সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের পিছনে ওয়ালিদের এই কালো টাকা ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
হিমায়িত ব্যাংক হিসাব ও কর ফাঁকি
সম্প্রতি এনবিআরের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে কর ফাঁকির অভিযোগে। ডিউটি ফ্রি ওয়্যার হাউস এর ব্যবসার আড়ালে বাজারে বিদেশি মদ বিক্রি করে তার প্রতিষ্ঠান ইডিএস। শুল্ক গোয়েন্দারা কয়েকবার এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শুল্ক ফাকির অভিযোগে প্রতিষ্ঠানে হানা দিয়েছে ও ব্যাংক হিসাব বন্ধ করেছে। এছাড়া অন্যান্য জিএসএ ও ট্রাভেল এজেন্সির আর্থিক লেনদেনের তদন্তও শুরু হয়েছে।
কর কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুর রকিব সাংবাদিকদের বলেন, “যারা বাজার ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে কর ফাঁকি দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকার টিকিট ১.৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এই প্রতারণা বরদাস্ত করা হবে না।”
এনবিআরের সূত্র জানায়, মার্চ মাসে কয়েকটি ব্যাংকে ট্রানজেকশন হিস্ট্রি ও অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এনবিআরের পক্ষ থেকে আরও মন্তব্য প্রয়োজন
বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের প্রতিশ্রুত
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির পেছনে কারণ অনুসন্ধানে গঠিত নয় সদস্যের কমিটির প্রতিবেদন পরবর্তী সময়ে কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে।
এতে বলা হয়েছে, শুধু মুনাফাভিত্তিক চিন্তা না করে এয়ারলাইন্সগুলোকে জনসেবা দিকটিও বিবেচনায় নিতে হবে, বিশেষ করে রেমিট্যান্স নির্ভর শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর স্বার্থে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেন, “টিকিট বিক্রির নামে কোনো সিন্ডিকেট বা শোষণ বরদাস্ত করা হবে না। আমরা বিশেষ করে প্রবাসী শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও আরও মন্তব্য প্রয়োজন
গত জানুয়ারিতে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) এক সংবাদ সম্মেলনের পরপরই মন্ত্রণালয় ১১ ফেব্রুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, যাত্রীর নাম ও পাসপোর্ট অনুলিপি ছাড়া কোনো টিকিট বুক করা যাবে না।
এই নির্দেশনার ফলে মজুদকৃত টিকিটগুলো গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে (জিডিএস) ছাড়তে বাধ্য হয় এয়ারলাইন্সগুলো। এর ফলে দাম কমে আসে ও স্বচ্ছতা ফিরে আসে।
মূল্য কারসাজি ফাঁস
তদন্তে দেখা গেছে, ৩০টি ট্রাভেল এজেন্সি নাম ছাড়া টিকিট মজুদ করে সেগুলো হোয়াটসঅ্যাপের ক্লোজড গ্রুপে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করেছে। এদের সবাইকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে শুনানিতে ডাকা হয়েছে।
এই এজেন্সিগুলোর মধ্যে রয়েছে— কাজী এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, সিটিকম ইন্টারন্যাশনাল, কিং এয়ার এভিয়েশন, আরবিসি ইন্টারন্যাশনাল, মেগা ইন্টারন্যাশনাল, মাদার লাভ এয়ার ট্রাভেলস, জেএস ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস, সাদিয়া ট্রাভেলস, হাশেম এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, নারিয়া ট্রাভেলস, এলহাম কর্পোরেশন, এবং আল গাজি।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা অথবা সাব-এজেন্টদের মাধ্যমে টিকিট ব্লক করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করেছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
আটাব মহাসচিব আফসিয়া জান্নাত সালেহ অভিযোগ করেন, “জিএসএ-দের তৈরি একচেটিয়া বাজারে প্রকৃত এজেন্সিগুলোকে টিকিট সরবরাহ দেওয়া হয় না, যদিও তারা সব শর্ত পূরণ করে, এমনকি ব্যাংক গ্যারান্টিও দেয়। অনেক ক্ষেত্রে টিকেট বিক্রয় অথরিটি প্রদানের জন্য তারা বড় অংকের টাকা ঘুষ দাবী করে।”
৭৫ শতাংশ কমেছে ভাড়া
সরকারি হস্তক্ষেপের আগে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি সময়ে ঢাকা থেকে জেদ্দা, রিয়াদ, মদিনা ও দাম্মামের মতো সৌদি শহরগুলোতে টিকিটের দাম ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন বিদেশগামী শ্রমিকরা।
সরকারি হস্তক্ষেপের ফলে বর্তমানে ওই রুটগুলোর টিকিটের দাম গড়ে ৪৮ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে নেমে এসেছে যা পূর্বের তুলনায় প্রায় ৭৫ শতাংশ কম।
আটাব এক বিবৃতিতে বলেছে, “সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপে হাজার হাজার শ্রমিক ও ওমরাহযাত্রী উপকৃত হয়েছেন। এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। তবে সরকারের নির্দেশনা টেকসই ও স্থায়ী করতে জরুরী ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ আটাবের।”
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও উচ্চ মূল্য ও সিন্ডিকেট কারসাজির কুশিলবদের বিরুদ্ধে এখনো কোন ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। এদের বিরুদ্ধে এখনই যদি দৃশ্যমান কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলে ভবিষ্যতে কেউ উচ্চমুল্য, মজুতদারি ও সিন্ডিকেট করতে সাহস করবে না।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.