বিশেষ প্রতিবেদক
Published:2025-05-28 08:22:09 BdST
যেভাবে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ হয়ে ওঠেন সুব্রত বাইন
দেশের অপরাধ জগতের গডফাদার, তালিকাভুক্ত ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’দের একজন সুব্রত বাইন। নব্বইয়ের দশকে রাজধানীর দক্ষিণাংশে অপরাধ জগতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে।
সুব্রত ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মোল্লা মাসুদ ওরফে আবু রাসেল মাসুদসহ চারজন সেনাবাহিনীর এক অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন। মঙ্গলবার (২৭ মে) ভোর ৫টা ১৫ মিনিটে কুষ্টিয়ার সোনার বাংলা রোডের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে সুব্রত ও মাসুদকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সকাল ৭টায় রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুই জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন শুটার আরাফাত ও শরীফ ওরফে ড্রাইভার শরীফ।
গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় হত্যা, চাঁদাবাজিসহ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের একাধিক মামলা রয়েছে। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ ‘সেভেন স্টার’ নামে পরিচিত সন্ত্রাসী দলের নেতা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঢাকার হাতিরঝিল ও গুলশান এলাকায় সংঘটিত তিনটি হত্যাকাণ্ডে সুব্রত বাইনের সংশ্লিষ্টতার তথ্য মিলেছে। খুন ছাড়াও জমি ও ফ্ল্যাট দখল, চাঁদাবাজির নানা ঘটনার সঙ্গেও তার বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২১ এপ্রিল রাজধানীর হাতিরঝিলে সুব্রত বাইনের অনুসারীদের গুলিতে ওয়ার্ড যুবদলের সদস্য আরিফ সরদার নিহত হন। সীমান্তপথে ভারত থেকে অস্ত্র এনে তা দিয়ে খুনসহ নানা অপরাধে ব্যবহার করে তার বাহিনী।
নব্বইয়ের দশকে দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে ঢাকার মগবাজার এলাকার সুব্রত বাইনের নাম উঠে আসে। এসব অপরাধ সংঘটনের সময় অসংখ্য খুন-জখমের ঘটনাও ঘটান তিনি। একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে জেলেও যান, কিন্তু জামিনে বেরিয়ে আবার অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
সুব্রত বাইনের পুরো নাম ত্রিমাতি সুব্রত বাইন। জন্ম ১৯৬৭ সালে, ঢাকার হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। পৈতৃক নিবাস বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার জোবারপাড় গ্রামে। তার বাবা বিপুল বাইন ছিলেন একটি এনজিওর গাড়িচালক। মা কুমুলিনি বাইন ও তিন বোন মেরি, চেরি ও পরীকে নিয়ে তারা ঢাকার মগবাজারে বসবাস করতেন।
শৈশবে বরিশালের অক্সফোর্ড মিশন স্কুলে পড়াশোনা শুরু করলেও পরে ঢাকায় চলে আসেন। এসএসসি পাস করার পর সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করলেও কলেজে আর যাওয়া হয়নি। এক রাজনৈতিক নেতার ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে তার অপরাধ জগতে প্রবেশ ঘটে।
১৯৯৩ সালে মধুবাজারে এক সবজি বিক্রেতা হত্যার ঘটনায় প্রথম পুলিশের নজরে আসে সুব্রতের নাম। পরে বিশাল সেন্টারে চাঁদাবাজি নিয়ে গোলাগুলির ঘটনায় গণমাধ্যমে উঠে আসে তার পরিচিতি। ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী এবং স্থানীয় রাজনীতিকদের ছত্রচ্ছায়ায় হয়ে ওঠেন আরও বেপরোয়া।
১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ট্রিপল মার্ডারের নেতৃত্ব দেন তিনি। সিদ্ধেশ্বরীর খোকন, মগবাজারের রফিকসহ অনেককে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ১৯৯১ সালে আগারগাঁওয়ে মুরাদ হত্যা মামলায় তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
সুব্রত বাইন রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও গড়ে তোলেন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে একটি দলের হয়ে মগবাজার এলাকায় সক্রিয় ছিলেন তিনি। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তার জন্মদিনে ওই দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত থাকতেন। এই কারণে সুব্রত বাইন ‘তারকা সন্ত্রাসী’র তকমা পান।
এক পর্যায়ে যুবলীগের লিয়াকতের সঙ্গে মগবাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষেও জড়ান। ১৯৯৭ সালে নয়াপল্টনের একটি হাসপাতাল থেকে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম হোসেন তাকে গ্রেপ্তার করেন। দেড় বছর জেলে থাকার পর জামিনে বের হয়ে ফের অপরাধে জড়িয়ে পড়েন।
২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর সরকার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় শীর্ষে ছিল তার নাম। ওই বছরই ইন্টারপোল তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে, যা এখনও বলবৎ রয়েছে।
রেড নোটিশ জারির পর তিনি কলকাতায় পালিয়ে যান এবং সেখানেও অপরাধে সক্রিয় থাকেন। ২০০৮ সালে কলকাতা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে পালিয়ে যান নেপালে, আবারও ধরা পড়েন। শেষবার ২০১২ সালে কলকাতায় গ্রেপ্তার হন সুব্রত বাইন। পরে দীর্ঘদিন তার অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য ছিল না।
গণঅভ্যুত্থানের পর আত্মগোপনে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে আসেন। এমনই একজন সুব্রত বাইন। ২৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মগবাজারের বিশাল সেন্টারে দলবল নিয়ে তার মহড়া দেওয়ার খবর সামনে আসে। অনেকে তাকে প্রথমে চিনতে পারেননি। মুখে দাড়ি রেখেছেন, চেহারায়ও বেশ পরিবর্তন এসেছে।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.