October 10, 2025, 3:04 am


নেহাল আহমেদ, কবি ও সাংবাদিক

Published:
2025-10-09 23:59:30 BdST

২০২৫ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্ত লেখকের লেখার শক্তি কি?


সাহিত্যে ২০২৫ সালের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন হাঙ্গেরির লেখক লাজলো ক্রাজনাহোরকাই। আধুনিক কথাসাহিত্যে তাঁর গভীর ও উদ্ভাবনী অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তার নামে এই পুরস্কার ঘোষণা করে সুইডিশ একাডেমি।

সুইডিশ অ্যাকাডেমি তাঁর দক্ষতার প্রশংসা করেছে—‘শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার নির্মম লড়াইকে স্বপ্নময় দৃশ্য ও উদ্ভট চরিত্রায়নের’ মধ্য দিয়ে উপস্থাপনের জন্য।

 

হাঙ্গেরীয় লেখক লাজলো ক্রাজনাহোরকাই (László Krasznahorkai) ইউরোপের আধুনিক সাহিত্যের এক অনন্য ও জটিল কণ্ঠ। তিনি নোবেল পাওয়া দ্বিতীয় হাঙ্গেরীয় লেখক। এর আগে ২০০২ সালে ইমরে কেরতেজ এই সম্মান পান। এটি প্রমাণ করে, অস্তিত্বগত ও সামাজিক অস্থিরতা নিয়ে মধ্য ইউরোপীয় লেখকদের অনুসন্ধান এখনো অ্যাকাডেমির বিশেষ মনোযোগে রয়েছে।

কেন তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে

২০২৫ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, যা তার দীর্ঘদিনের সাহিত্যচর্চার পুরষ্কার স্বরূপ। তিনি প্রায় চার দশক ধরে বিশ্বসাহিত্যে এক ধীর, গভীর, ও দার্শনিক ভাষার ভেতর দিয়ে মানুষের অস্তিত্ব, সময়, ও পতনের গল্প লিখে গেছেন। ক্রাজনাহোরকাইয়ের লেখায় আধুনিক জীবনের বিশৃঙ্খলা অনন্য সাহিত্যিক ভঙ্গিতে ফুটে ওঠে।

তাঁর লেখার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো দীর্ঘ, বিরামচিহ্নহীন বাক্যরীতি। এই গদ্যধারা একধরনের ছন্দ তৈরি করে, যা তাঁর গল্পের বিশৃঙ্খল প্রবাহকে প্রতিফলিত করে। প্রথমদিকের লেখাগুলো থেকেই এই শৈলী বিকশিত হয়েছে। এতে দর্শনচিন্তা ও প্রবল অনুভূতির সমন্বয় ঘটে। তাঁর রচনায় ধ্বংস, সহিংসতা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সৌন্দর্য, নশ্বরতা ও শিল্পসৃষ্টির রহস্য নিয়ে গভীর অনুসন্ধান দেখা যায়।

সমালোচক সুসান সনটাগ তাঁকে বলেছেন ‘সমকালীন সাহিত্যের প্রলয়ের গুরু।’ অ্যাকাডেমির সিদ্ধান্তেও এই ধারণার প্রতিফলন আছে। অ্যাকাডেমি বলেছে, মানব সভ্যতার ভঙ্গুরতা তুলে ধরার তাঁর দক্ষতাই তাঁকে অনন্য করেছে।

এই পুরস্কার এমন এক সময়ে এলো, যখন পৃথিবী জুড়ে রাজনৈতিক সংঘাত ও সাংস্কৃতিক বিভাজন ক্রমে বাড়ছে। ক্রাজনাহোরকাইয়ের রচনা সেই অনিশ্চয়তার প্রতিধ্বনি বহন করে।

একই সঙ্গে, ২০২৪ সালের পর (হান কাংয়ের জয়ের পর) নোবেল কমিটির মনোযোগে ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদী ধারার প্রতি নতুন করে আগ্রহের প্রতিফলনও দেখা যায়— যেখানে ঐতিহ্য ও নতুনত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে।

তাঁর অবদান কী

লাজলো ক্রাজনাহোরকাই ১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির রোমানিয়া সীমান্তবর্তী ছোট শহর জিউলাতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে উপন্যাস, ছোটগল্প, চিত্রনাট্য ও প্রবন্ধের সমন্বয় দেখা যায়। জন্মভূমির সমাজতান্ত্রিক যুগের নিঃসঙ্গতা ও চীন-জাপান সফরের অভিজ্ঞতা তাঁর লেখায় গভীর প্রভাব ফেলেছে।

তাঁর প্রথম উপন্যাস সাতানতাঙো (১৯৮৫) প্রকাশের পরই হাঙ্গেরিতে আলোড়ন তোলে। উপন্যাসটিতে পতনের পথে থাকা এক সমবায় খামারের নিঃস্ব মানুষের প্রতারণা ও ভাঙনের গল্প তুলে ধরা হয়। পরিচালক বেলা তার পরবর্তীতে এটি সাত ঘণ্টাব্যাপী চলচ্চিত্রে রূপ দেন। এই কাজের মাধ্যমেই ক্রাজনাহোরকাই শুরু করেন তাঁর ‘সামাজিক প্রলয়ধর্মী’ মহাকাব্যিক ধারার রচনা।

এর পরের উপন্যাসগুলো—দ্য মেলানকলি অব রেজিস্ট্যান্স (১৯৮৯), ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার (১৯৯৯), ব্যারন ভেনকহাইম’স হোমকামিং (২০১৬), এবং হারশট ০৭৭৬৯ (২০২১)—প্রতিটিই সামাজিক ভাঙন ও মানব হতাশার বিভিন্ন রূপ তুলে ধরে। এসব রচনায় অরাজকতা, ধ্বংস, সহিংসতা ও অস্তিত্বের অনিশ্চয়তা বারবার ফিরে আসে।

পূর্ব এশিয়ায় ভ্রমণ পরবর্তী সময়ে তাঁর লেখার ভঙ্গি হয়ে ওঠে আরও ধ্যানমগ্ন ও কাব্যময়। অ্যা মাউন্টেন টু দ্য নর্থ, অ্যা লেক টু দ্য সাউথ, পাথস টু দ্য ওয়েস্ট, অ্যা রিভার টু দ্য ইস্ট (২০০৩) কিয়োটোর এক গোপন বাগান অনুসন্ধানের কাব্যিক যাত্রা। তাঁর গল্পগ্রন্থ সেইওবো দেয়ার বিলো (২০০৮)-তে ১৭টি গল্পের মাধ্যমে সৌন্দর্যের ক্ষণস্থায়িত্ব ও সৃষ্টির রহস্য অনুসন্ধান করা হয়েছে।

সংক্ষিপ্ত রচনাগুলোর মধ্যেও তাঁর স্বতন্ত্র স্বর ধরা পড়ে। স্পেডওয়ার্ক ফর অ্যা প্যালেস (২০১৮)-তে নিউইয়র্কের এক গ্রন্থাগারিকের চোখে সাহিত্যিক হেরম্যান মেলভিলের স্মৃতি ও উন্মাদনা মিশে যায়।

গদ্যের বাইরে তাঁর প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে চলচ্চিত্র ও সংগীতেও। তিনি বেলা তারের একাধিক চলচ্চিত্রের (যেমন ড্যামনেশন, ওয়ের্কমিস্টার হারমোনিজ, দ্য তুরিন হর্স) চিত্রনাট্য লিখেছেন, যেখানে অর্থহীনতা ও মহাজাগতিক ভয় প্রতিফলিত হয়েছে। ২০২৪ সালে তাঁর রচিত অপেরা ‘মেলানকোলি দেস ভিডেরস্ট্যান্ডস’ তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।

সর্বোপরি, ক্রাজনাহোরকাই একুশ শতকের জন্য সাহিত্যের উপন্যাস ধারাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তাঁর রচনাগুলো বিশাল, নিবিড় ও নির্মমভাবে অযৌক্তিক—যেখানে বিশৃঙ্খলার আকর্ষণ ও শিল্পের মুক্তির শক্তি একসঙ্গে ধরা পড়ে। তাঁর বই ৩০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, যা হাঙ্গেরীয় সাহিত্যকে বিশ্বপরিসরে আরও উজ্জ্বল করেছে।

পর্যবেক্ষণ

ক্রাজনাহোরকাইর খুবই সাদামাটা কিন্ত গভীর অর্থবহ একটা গল্প পড়ার চেষ্টা করলাম। কপিরাইটের কারনে পুরো গল্পটা পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে কাহিনী খুবই সাধারণ মনে হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অনেকটা এরকম; রাজা আসে রাজা যায়। আমাদের দেশে যেমন মিথ্যা প্রতিশ্রিতি দিয়ে নেতারা ক্ষমতায় আসীন হন। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় জনগনের ভাগ্য উন্নয়নের পরিবর্তে নিজের ভাগ্যকে বদলে নিয়েছেন। যেন কিছুদিনের জন্য জনগনের ভাগ্যের টেন্ডার নেয়া ব্যক্তি। খুবই চেনাজানা। অনেকটা আমাদের চারপাশের চরিত্রের মতোই।

“শয়তানের ট্যাঙ্গো” দার্শনিক, আধুনিকতাবাদী, প্রতীকধর্মী উপন্যাসে লেখা গল্পের কাহিনি অনেকটা এরকম -একটি দূরবর্তী, কাদা-পূর্ণ, প্রায় পরিত্যক্ত গ্রাম।
বৃষ্টি যেন থামে না—অবিরাম ঝরে পড়ছে, যেন আকাশ নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে জীবনের ওপর।

এই গ্রামে বেঁচে থাকা কিছু মানুষ—একদল ভগ্নস্বপ্নের বাসিন্দা—তাদের দিন কাটে প্রতারণা, আশা আর হতাশার এক ট্যাঙ্গো নাচে। সবাই অপেক্ষা করছে এক ব্যক্তির জন্য—ইরিমিয়াস—যে একসময় মৃত ভেবে ফেলা হয়েছিল। কথা ছড়িয়ে পড়ে, সে ফিরে আসছে।

ইরিমিয়াস—এক রহস্যময় নেতা, আধা-দার্শনিক, আধা-শয়তান—ফিরে আসে, যেন শেষ আশার দূত। সে প্রতিশ্রুতি দেয়—সবাইকে মুক্ত করবে, নতুন জীবন দেবে, এই পচনশীল গ্রাম থেকে মুক্তি।

কিন্তু আসলে সে কী? ত্রাণকর্তা, না ধ্বংসদূত?

মানুষেরা তার কথায় মোহিত হয়ে নিজেদের জমি বিক্রি করে, ঘর ছেড়ে দেয়, বিশ্বাস করে—এক নতুন সূর্য উঠবে। কিন্তু শেষে দেখা যায়, তারা শুধু আরেকটি প্রতারণার শিকার। সবকিছু ঘুরে ফিরে একই জায়গায় আসে,

যেমন ট্যাঙ্গো নাচে—এক পা সামনে, দুই পা পেছনে—
এক অনন্ত বৃত্তে, যেখানে মানুষ নিজের ছায়াকেই শয়তান ভেবে নাচে।

এই গল্পের মাধ্যমে লেখক প্রশ্ন তোলেন: “আমরা কি সত্যিই মুক্তি চাই, নাকি কেবল প্রতারণায় শান্তি পাই?” পাঠকের মনে জন্মায় হিপনোটিক অনুভূতি — যেন কাদা, বৃষ্টি, আর হতাশার মধ্যে হাঁটছেন তিনিও।

দার্শনিক প্রেক্ষিত বইটি মূলত “আশা বনাম হতাশা” নিয়ে। সমাজতান্ত্রিক ইউরোপের পতনের প্রেক্ষাপটে লেখা হলেও এটি সার্বজনীন, মানুষের অর্থহীন জীবন, বিশ্বাসের ভাঙন, আর নৈতিকতার বিলুপ্তি তুলে ধরে।

অনেক সমালোচক একে মনে করেন “কাফকা-র দুঃস্বপ্ন আর Beckett-এর শূন্যতার মাঝে এক দীর্ঘ নৃত্য।”

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.