October 21, 2025, 12:07 am


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2025-10-20 20:36:01 BdST

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ৫ কর্মকর্তার অনিয়ম দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন!


নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ইনল্যান্ড পরীক্ষায় অনিয়ম দুর্নীতি এবং বাংলাদেশ মেরিণ একাডেমী পাবনার কমান্ডেন্টের নানা অনিয়ম দুর্নীতির তদন্তে কমিটি গঠন ও অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের মৌখিক বক্তব্য গ্রহন করা হয়েছে।

এই বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের জাহাজ শাখা থেকে একটি নোটিশ জারি করা হয়। যার স্মারক নম্বর: ১৮,০০,০০০০,০২৪,৯৯,০০১,২৪-৫২৮ তারিখ: ১৫/৯/২০২৫ ইং।

বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, পাবনা'র বিভিন্ন অনিয়ম এবং নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ইনল্যান্ড মেরিন পরীক্ষায় অনিয়মের বিষয়ে তদন্তের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও যুগ্মসচিব মো: ফিরোজ আহমেদ-এর সভাপতিত্বে গত ১৬ই অক্টোবর সকাল ১০টায় মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে (কক্ষ নং-৮০৬, ভবন নং-৬, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা) একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। অভিযুক্তরা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে উপস্থিত হলে তাদের মৌখিক বক্তব্য গ্রহন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য যে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের ইনল্যান্ড মাস্টার ও ড্রাইভার পরীক্ষায় নানা কৌশলে দুর্নীতি করা হয়। এই খাতে প্রতি পরীক্ষায় লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করা হয়।

অভিযুক্ত কর্মকর্তারা হলেন: ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন, চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার, নৌপরিবহন অধিদপ্তর, আগারগাঁও, ঢাকা। ক্যাপ্টেন মো: তৌফিকুল ইসলাম; কমান্ড্যান্ট, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, পাবনা। মো: আবুল বাসার, ইঞ্জিনিয়ার এন্ড শিপ সার্ভেয়ার এন্ড এক্সামিনার, নৌপরিবহন অধিদপ্তর, আগারগাঁও, ঢাকা। মো: কাদের, কম্পিউটার অপারেটর, নৌপরিবহন অধিদপ্তর, আগারগাঁও, ঢাকা।

গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বিদেশি জাহাজের চাকরি ছেড়ে ২০১২ সালে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্সামিনার পদে নিয়োগ পান। পর্যায়ক্রমে কন্ট্রোলার অব এডুকেশন ও প্রিন্সিপাল অফিসার এবং সর্বশেষ চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ারের (চলতি) দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি।

সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ধারাবাহিক অব্যাহতিপত্র (কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট-সিডিসি) প্রদান নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে গিয়াস ও তাঁর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। ২০২৩ সালে অযোগ্য ও অদক্ষ নাবিকদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৮-১০ লাখ টাকা নিয়ে আরামবাগ প্রেসে ছাপানো নকল ‘পানামা সিডিসি’র অনুকূলে ১২৭টি বাংলাদেশি সিডিসি প্রদান করে এই সিন্ডিকেট। এতে ১২ কোটি ৭০ লাখ টাকা অবৈধ আয় হয় তাদের।

সরকারি-বেসরকারি মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা ভঙ্গ করে অধিদপ্তরের অনুমোদনবিহীন ‘প্রি-সি স্পেশাল রেটিং কোর্স’ চালু এবং ২০০ জনকে সিডিসি প্রদানের জন্য নির্বাচিত করাসহ জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা করে ১০০ কোটি টাকা অগ্রিম গ্রহণের অভিযোগও রয়েছে গিয়াসের বিরুদ্ধে। এই বিষয়ে দুটি মামলা আপিল বিভাগে শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ। এছাড়া আন্তর্জাতিক মেরিটাইম আইনের লঙ্ঘন ও জালিয়াতির মাধ্যমে গিয়াস অবৈধভাবে ইন্দোনেশিয়া, পানামা, ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়ার নেভিগেশন সার্টিফিকেট দিয়েছেন। এতে এসব দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিনের দুর্নীতি-অনিয়ম বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন অধিদপ্তর, এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) বহু আগে তদন্ত করেছিল। কিন্তু ‘গোপালগঞ্জ পরিচয়’ এবং পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের প্রভাবে বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন তিনি। জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলেনের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা পালনের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

ঢাকা মহানগরীতে ১০টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের মালিক গিয়াস উদ্দিন। এর মধ্যে রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর (নতুন ১৬ নম্বর) রোডের ইস্টার্ন ডালিয়ার এ/৪ নম্বর ফ্ল্যাটে বসবাস করেন তিনি। ২ হাজার ৫০০ বর্গফুটের এই ফ্ল্যাটের বাজারমূল্য ৫ কোটি টাকা।

তাঁর মালিকানাধীন অন্য ফ্ল্যাটগুলো হচ্ছে– ধানমন্ডি ৭/এ নম্বর রোডের বিশ্বাস ক্রিডেন্সে (বাড়ি নম্বর ৬৭) ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের ৩ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট (ফ্ল্যাট নম্বর ডি/৪); ধানমন্ডি ৭ নম্বর রোডের রেজাস ড্রিমে (হাউস নম্বর ৩১) ৫ কোটি টাকা মূল্যের ২ হাজার ৪০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট (ফ্ল্যাট নম্বর সি/৩); ধানমন্ডি ৬ নম্বর রোডের (মিরপুর রোড) মীর অনিকা ইয়াকুব কমার্শিয়াল টাওয়ার (হাউস নম্বর ১৭) দ্বিতীয় তলায় ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট; খিলগাঁও প্রধান সড়কসংলগ্ন র‌্যাংগস ভবনে ৫ কোটি টাকা মূল্যের ২ হাজার ৫০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট (নম্বর এ/৮, এ/৯); উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের ৬ নম্বর রোডে স্বপ্নধারা হাউজিংয়ে (বাসা নম্বর ৪৬/৩) ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ২ হাজার ৪০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট; একই রোডের ইস্টার্ন হাউজিংয়ে (বাসা নম্বর এ/৭) ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা মূল্যের ২ হাজার ২০০ বর্গফুট ফ্ল্যাট; উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রোডের জিবিডিএল পার্কে (বাসা নম্বর ৪৬/৩) ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা মূল্যের ২ হাজার ৪০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট; উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর রোডের ডোমিনো-এ (বাসা নম্বর ডি/৮) ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা মূল্যের ১ হাজার ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট এবং মিরপুর ডিওএইচএসের ৬ নম্বর রোডে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা মূল্যের ২ হাজার ২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট (বাসা নম্বর এ/৩)।

এদিকে, ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ব্লক-ই-তে পাঁচ কাঠা এবং গাজীপুরের পুবাইলের পূর্বাচল মেরিন সিটিতে পাঁচ কাঠা করে দুটি প্লট রয়েছে গিয়াসের।

পাঁচটি আধুনিক মডেলের গাড়ি ব্যবহার করেন গিয়াস। এর মধ্যে একটি ব্ল্যাক প্রিমিও ও দুটি এক্স করোলা ব্র্যান্ডের প্রাইভেটকার এবং দুটি সর্বশেষ মডেলের নোয়া মাইক্রোবাস। এ ছাড়া চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে বেসরকারি ওশান মেরিটাইম একাডেমিতে গিয়াসের স্ত্রী সাজেদা আহমেদের মালিকানা আছে। জালিয়াতির দায়ে সিআইডি পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে বন্ধ হওয়া ওজিমা নামের আরেকটি মেরিন একাডেমির কাগজপত্রে গিয়াসের ৫১ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। গিয়াসের প্রভাব খাটিয়ে তাঁর বড় শ্যালক মোখলেছুর রহমান লিটন ঢালী বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ধানমন্ডিতে ‘ভূতের আড্ডা’ নামে রেস্তোরাঁ আছে লিটনের।

সূত্র জানায়, গিয়াস ও তাঁর স্ত্রী সাজেদার নামে ১৩টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এসব হিসাবের মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। গিয়াসের নামে থাকা হিসাবগুলো ইসলামী ব্যাংক লোকাল অফিস, ঢাকা; ব্র্যাক ব্যাংক, দিলকুশা শাখা; আইএফআইসি ব্যাংক, মতিঝিল শাখা; ন্যাশনাল ব্যাংক দিলকুশা শাখা; সোনালী ব্যাংক প্রধান কার্যালয় এবং যমুনা ব্যাংক, ধানমন্ডি ও দিলকুশা শাখা এবং ওয়ান ব্যাংক, ধানমন্ডি শাখায় রয়েছে। সাজেদার নামে সোনালী ব্যাংক কাকরাইল; প্রিমিয়ার ব্যাংক ধানমন্ডি; ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ধানমন্ডি; উত্তরা ব্যাংক, ধানমন্ডি ও আইএফআইসি ব্যাংক, ধানমন্ডি শাখায় প্রচুর অবৈধ টাকা জমা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অপরদিকে, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, পাবনা এর কমান্ড্যান্ট ক্যাপ্টেন মো: তৌফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে একাডেমির পুকুরে ব্যক্তিগতভাবে মাছ চাষ ও বিক্রি, ক্যাডেটদের খাবারের টাকা থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন খাওয়া, ভূয়া টেন্ডারের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ, চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকের অধিকতর ক্লাস দেখিয়ে টাকা ভাগাভাগি, নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া, নারী সহকর্মীকে যৌন নির্যাতন সহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে।

অন্যান্য অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে 'দি ফিন্যান্স টুডে'র একটি চৌকস টীম ব্যাপক অনুসন্ধান শুরু করেছে। এনিয়ে বিস্তারিত তথ্য আগামী প্রতিবেদনে প্রকাশিত হবে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.