বিশেষ প্রতিবেদক
Published:2025-11-06 20:01:41 BdST
ভ্রমন ভাতা বাবদ ৩ লক্ষ টাকা এবং ভুয়া বিল ভাউচারে ২,৭৬,০০০/- টাকা আত্মসাতের অভিযোগমাগুরায় সহকারী পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রেশমা খাতুনের বিধিবহির্ভূত নিয়োগ বাতিলের দাবি
অভিযুক্ত রেশমা খাতুন ও দারুল আলম
মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের টিএফপিএ (তৃতীয় শ্রেনী) রেশমা খাতুনকে নিজ কর্মস্থলে দায়িত্ব পালনকালে বিধিবহির্ভূতভাবে একই জেলার সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে সহকারী পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (দ্বিতীয় শ্রেনী) পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর এই বিধিবহির্ভূত নিয়োগের মাধ্যমে অভিযুক্ত রেশমা খাতুন সরকার নির্ধারিত বেতনের অতিরিক্ত অর্থ অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন।
উল্লেখ্য, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১৮/০৪/২০২৩ইং তারিখে জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপন (বিধি-১ শাখার স্মারক নং-০৫.০০.০০০০.১৭০.১১.০১৭.২১-৯৭) অনুযায়ী কোন সরকারি কর্মচারীকে মূল পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে মূল পদে/গ্রেডের সম পদ/সমগ্রেড অনুযায়ী নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।
এক্ষেত্রে, তৃতীয় শ্রেনীর পদে কর্মরত রেশমা খাতুনকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কর্তৃক ২০১৭ সালের ২২মে জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিধিবহির্ভূতভাবে দ্বিতীয় শ্রেনীর পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগবিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
এছাড়া, তৎকালীন সরকারি বেতন স্কেলের ১৫ তম গ্রেডে ৯,৭০০-২৩,৪৯০ এ কর্মরত তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী রেশমা খাতুনকে ১৪ তম উচ্চতর গ্রেডে ১০,৪০০-২৪,৬৮০ বেতনে (তৃতীয় শ্রেনী) অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানের কথা থাকলেও সরকারী নিয়োগ বিধিমালা সংক্রান্ত নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে দ্বিতীয় শ্রেনীর সমমর্যাদা অর্থাৎ ১৫ তম গ্রেড থেকে ৫ ধাপ অতিক্রম করে ১০ম গ্রেড (১৬,০০০-৩৮,৬৪০) এ অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। রেশমা খাতুনকে দেয়া এই নিয়োগ সরকারি বিধিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থী এবং বিধিবহির্ভূত।
এখানেই শেষ নয়, রেশমা খাতুনকে দেয়া এই অবৈধ নিয়োগের ক্ষেত্রে আরও একটি সরকারী নিয়োগ সংক্রান্ত বিধান ভঙ্গ করা হয়েছে। সরকারি নিয়োগ-বিধি অনুযায়ী, কোন একটি নির্দিষ্ট পদে দায়িত্ব পালনরত কোন কর্মচারীকে মূল পদের অতিরিক্ত কোন পদে দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে ছয় (০৬) মাসের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। ছয় (০৬) মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই সংশ্লিষ্ট পদোন্নতি কমিটি বা বোর্ডের অনুমোদন গ্রহন করতে হবে। এই অনুমোদন গ্রহন করতে ব্যর্থ হলে ছয় (০৬) মাস পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে উক্ত নিয়োগ/পদায়ন সংক্রান্ত আদেশ/প্রজ্ঞাপন বাতিল বলে গন্য হয়।
এক্ষেত্রে, তৃতীয় শ্রেনীর পদে কর্মরত রেশমা খাতুনকে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কর্তৃক ২০১৭ সালের ২২মে জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিধিবহির্ভূতভাবে দ্বিতীয় শ্রেনীর পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করার পর আট (০৮) বছর অতিবাহিত হলেও অদ্যাবধি সংশ্লিষ্ট পদোন্নতি কমিটি বা বোর্ডের অনুমোদন গ্রহন করা হয়নি। এর ফলে, নিয়োগ-পদোন্নতি সংক্রান্ত এই বিধিমালা সুস্পষ্টভাবে ভঙ্গ করা হয়েছে।
এছাড়াও, সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূত ও বেআইনিভাবে তৃতীয় শ্রেণীর পদে কর্মরত রেশমা খাতুন সরকারি পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদে স্থায়ীভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তার মৌলিক ভ্রমন ভাতা এবং বদলী ভ্রমন ভাতা বাবদ তিন (০৩) লক্ষ টাকা অন্যায়ভাবে গ্রহন করেছে।
এছাড়াও, অভিযুক্ত রেশমা খাতুন খুলনা কর্মচারী কল্যান বোর্ড হতে ২,৭৬,০০০/- টাকা ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে চিকিৎসা বাবদ অন্যায়ভাবে উত্তোলন করেছেন। এটি সরকারি চাকুরী-বিধিমালা ভঙ্গ করার কারণে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গন্য করা হয়েছে।
এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রেশমা খাতুন কর্তৃক অবৈধভাবে আত্মসাৎকৃত সমুদয় অর্থ আদায়পূর্বক সরকারি কোষাগারে জমা করার জন্য লিখিত আবেদন করেছেন।
বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, রেশমা খাতুন কর্তৃক খুলনা কর্মচারী কল্যান বোর্ড থেকে জাল ও ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে ২,৭৬,০০০/- টাকা আত্মসাতের সাথে তৎকালীন মাগুরা জেলার সদর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দারুল আলম সরাসরি জড়িত। বর্তমানে ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদে কর্মরত দারুল আলম মাগুরা জেলায় দায়িত্ব পালনকালে পরস্পর যোগসাজশ করে রেশমা খাতুন কর্তৃক প্রদত্ত সকল বিল ভাউচার যাচাই-বাছাই ছাড়াই সঠিক বলে প্রতিসাক্ষর করে খুলনা কর্মচারী কল্যান বোর্ডে প্রেরন করেন। পরবর্তীতে প্রাপ্ত অর্থ দারুল আলম এবং রেশমা খাতুন ভাগাভাগি করে আত্মসাৎ করেন। এই ব্যাপারে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দারুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য আবেদন করেছেন।
উল্লেখ্য যে, অনিয়ম, দুর্নীতি আর পদবাণিজ্য করে নামে-বেনামে নানা সম্পত্তিসহ কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া দারুলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ কর্ম কমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে জমেছে অভিযোগের পাহাড়। কিন্তু এরপরও বহাল আছেন তিনি।
অভিযুক্ত দারুল আলম পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নিয়োগ বাণিজ্য চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, নড়াইল, সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলার লোকজনকে ঘুস নিয়ে চাকরি পাইয়ে দেন। তার দুর্নীতির ফিরিস্তি ঘাঁটতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তিনি মাগুরার সদর উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা সহকারী (টিএফপিএ) থাকাকালে তার লাগামহীন দুর্নীতি ঠেকাতে মাগুরা সদরের মাঠ কর্মচারীরা তাকে বদলির জন্য আবেদন করেন।
একই অভিযোগের কারণে দুদক কাগজপত্র জব্দসহ তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। এরপর চাকরিতে ফিরে তিনি ফের দুর্নীতি চালিয়ে যান। সেই সময় ভুয়া বিল-ভাউচার ও ভ্রমণভাতা তোলাসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হন। এর মধ্যে তিনি মাগুরা সদর গোপালগ্রাম পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শিকা মুক্তি রানী কর্মকারের বেতন হতে টাকা আত্মসাৎ করেন। এই বিষয়টিও তৎকালীন উপ-পরিচালক পর্যন্ত গড়ায়।
ঘুস-দুর্নীতি আর নিয়োগ বাণিজ্যে দারুল আলম এতটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন যে মাগুরা হতে একই পরিবারের ৫ জন এবং অপর পরিবারের ২ জনসহ মোট ১৫ জনকে চাকরি দেন। একই পরিবারের ৫ নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মী হলেন সুরাইয়া আহমেদ, ঝুনা পারভীন, মাহফুজা খানম দিনা, কামরুল ইসলাম ও নূরজাহান বেগম। এদের মধ্যে প্রথম তিনজন বোন। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এদের বয়স ৪০ বছরের উপরে, যা একেবারেই নজিরবিহীন ঘটনা।
এদিকে, স্বজনপ্রীতির নগ্নতম উদাহরণ স্থাপন করে নিজের পরিবারের সদস্যদের নিয়োগেও দারুল আলম এগিয়ে আছেন। নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন তার শ্যালিকা জাহানারা পারভীন ও চাচাতো বোন শামছুন নাহার পলি। তবে, দারুল ইসলাম যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার হাকিমপুর ইউনিয়নের স্থায়ী বাসিন্দা দেখিয়ে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে তার আরেক শ্যালিকা শাহানারা খাতুনকে মাগুরা জেলার পরিবার কল্যান পরিদর্শিকা পদে নিয়োগ পাইয়ে দেয়। পরবর্তীতে, প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় তদন্ত কমিটি কর্তৃক শাহানারা খাতুনের নিয়োগ অবৈধ বলে গন্য হয় এবং তাকে চাকুরী হতে অব্যাহতি দেয়া হয়।
এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়স গোপনসহ আরও অনেক বেআইনি কাজ করেছেন তিনি। ভুয়া অষ্টম শ্রেণি পাশের সার্টিফিকেট, দাই-নার্সের ভুয়া সনদ তৈরিসহ ১৮-২০ বছর আগে তোলা ছবি ব্যবহার করেছেন। নিজের নিয়োগ বাণিজ্যের স্বার্থে এহেন কোনো বেআইনি পন্থা নেই যা তিনি অবলম্বন করেননি। তার এই বিষয়টিও তদন্তনাধীন। তদন্তের পর চলে গেছে প্রায় দুই বছর। কিন্তু ফলাফল শূন্য। ওই তিন বোন এখনও চাকরি করে যাচ্ছেন। কারও কারও নিয়োগে ভুয়া ঠিকানা পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন দারুল আলম। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতা ও অনৈতিক সুবিধা নিয়ে তিনি দিনের পর দিন এই ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছেন।
এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি, কোটা না থাকা সত্বেও ভুয়া তথ্য দিয়ে 'পরিবার কল্যান পরিদর্শিকা' পদে চাকুরী দেয়ার নাম করে বাগেরহাটের জনৈকা নাদিরা ইয়াসমিনের কন্যা জান্নাতুল ফেরদৌসের কাছ থেকে ১০,০০,০০০/- (দশ লক্ষ টাকা) ঘুষ নেন। এমনকি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে ভুয়া ভাইভা বোর্ড গঠন করে উক্ত জান্নাতুল ফেরদৌসের ভাইভাও নেয়া হয়। কিন্তু চুড়ান্ত ফলাফলের তালিকায় জান্নাতুল ফেরদৌসের কোন নামই ছিল না। অভিনব প্রতারণার মাধ্যমে ঘুষের পুরো টাকাই তিনি আত্মসাৎ করেন।
পরবর্তীতে ঘুষের টাকা ফেরত চেয়ে ১৯/০৩/২০২৩ ইং তারিখে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রণালয়ের সচিবের দপ্তরে দারুল আলমের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ভুক্তভোগীর নিকটাত্মীয় সাবেক উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা রেবেকা খাতুন।
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, গত ৫ বছরেও দারুল আলমের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এই অভিযোগের বিষয়ে কোন জবাব দেয়নি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। কালক্ষেপণের মাধ্যমে তারা আসলে তাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়াও দারুল আলমের বিরুদ্ধে দুদকে শত অভিযোগ থাকা সত্বেও তথ্য গোপন করে ২০/১০/২০২১ ইং তারিখে মন্ত্রনালয়ের স্মারক নং- পপ/শা-১/সপপক (চঃদাঃ)/৭৭৫/২০১০ একটি পত্রে অবৈধ ও অনৈতিক সুবিধা নিয়ে বা দিয়ে নিজের জন্য সিলেকশন গ্রেড/টাইম স্কেল নিয়েছে যা সম্পূর্ণভাবে সরকারের নিয়ম শৃঙ্খলাবিধির সুস্পষ্ট লংঘন।
দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, রাস্ট্রের অর্থ আত্মসাৎ, স্বজনপ্রীতি, নৈতিক চরিত্র স্থলন সহ হেন কোন অপরাধ নেই যা তিনি করেননি তার দীর্ঘ চাকুরী জীবনে। এত সব অপরাধ করেও কিভাবে দারুল আলম এখনও বহাল তবিয়তে সরকারি চাকরি করছেন; সেটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.
