November 10, 2025, 12:59 am


শাহীন আবদুল বারী

Published:
2025-11-09 22:13:04 BdST

২০ লক্ষ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ক্ষতির সম্ভাবনাভারতীয় মাফিয়া সিন্ডিকেটের কবলে বাংলাদেশের টেলিকম সেক্টর


> NEIR ঘোষণা ও বাণিজ্য-প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন

> ভেঙ্গে পড়তে পারে পুরো দেশের টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থা

> পরিবারের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে প্রবাসীদের যোগাযোগ

বিশেষ প্রতিবেদন 

সম্প্রতি বিটিআরসি তাদের নীতিমালা NEIR (National Equipment Identity Register) প্রণয়নের ঘোষণা দিয়েছে, যা আগামী ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে। ২৯ অক্টোবর, ২০২৫ তারিখে বিটিআরসি এমন ঘোষণাটি দিয়েছে। কিন্তু সেটি আগাম কোনো পরামর্শ বা বিস্তারিত সমাজস্বীকৃত সংলাপ ছাড়া নেয়া হয়েছে, এমনটাই দাবি করছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এবং বাজার পর্যবেক্ষকরা।

এই ঘোষণাটির মূল প্রতিশ্রুতি হলো, ১৬ ডিসেম্বর থেকে নতুন অ-নিবন্ধিত ডিভাইসগুলো জাতীয় নেটওয়ার্কে সংযোগ পাবে না।

সরকারি নিরাপত্তা ও রাজস্ব রক্ষার কথা বলে এই ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণের যুক্তি থাকলেও, নীতিটি সংক্ষিপ্ত সময়ে একপক্ষীয়ভাবে বাস্তবায়িত হলে তার বাজারগত প্রভাব কী হবে, সেই নিয়ে অনেকে উদ্বিগ্ন।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ

বিভিন্ন স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠন ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রকাশিত মন্তব্য অনুযায়ী, দেশের মোবাইল খাতে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজারের বেশি ব্যবসায়ী সরাসরি ব্যবসা করেন এবং এই খাতে জড়িত শ্রমিক, পরিবহন ও সার্ভিসিং ইত্যাদি যোগ করে প্রায় ২০ লাখের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল।

এই পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা এই NEIR সিস্টেমকে স্বাগত জানান কিন্তু  NEIR প্রয়োগের বর্তমান রূপরেখা অনুযায়ী হলে অনেক ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আর ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে না, ফলে বড় নির্মাতারা বা কিছু নির্দিষ্ট আমদানিকারকের আধিপত্য বাড়তে পারে।

কীভাবে এই সিদ্ধান্ত বাজারে সংকট সৃষ্টি করতে পারে — ব্যবসায়ীদের ব্যাখ্যা

বিটিআরসির নিয়ম অনুযায়ী, ইমপোর্ট লাইসেন্স থাকলেও, কেউ যদি কোনো ব্র্যান্ডের পণ্য আনতে চায়, তাহলে ঐ ব্র্যান্ড বা তাদের স্থানীয় ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটের ‘অনুমতি’ (NOC) প্রদানের শর্ত রয়েছে, এমন দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, বাস্তবে ঐ অনুমতি পাওয়া খুব কঠিন, এবং ফলে অনেক পাইকারি বা খুচরা ব্যবসায়ী বাজার থেকে হারিয়ে যাবে। এই সীমাবদ্ধতা অনুসরণে বাজার কনসেন্ট্রেট হয়ে ছোট একটি সিন্ডিকেট গোষ্ঠীর মধ্যে চলে আসতে পারে,এমন আশঙ্কা তারা ব্যক্ত করেছেন।

একাধিক ব্যবসায়ী ও পর্যবেক্ষকের বক্তব্যে বলা হয়েছে, এই বিষয়ে দুইটি বড় প্রশ্ন উঠেছে — প্রথম, NOC ধারাটি কীভাবে প্রয়োগযোগ্য ও স্বচ্ছ হবে; দ্বিতীয়, যদি কেবল কিছু ব্র্যান্ড ও আমদানিকারককেই সুবিধা হয়, তাহলে বাজারে প্রতিযোগিতা কোথায় থাকবে?

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

নীতিনির্মাতা ও অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষকে (BTRC) নীতিমালা প্রণয়নের আগে বিস্তৃত স্টেকহোল্ডার পরামর্শ ও বাস্তবভিত্তিক পর্যবেক্ষণ করা উচিত ছিল। তারা আরও বলেন, যে কোনো নীতি যদি বাজারে কয়েকটি বড় প্লেয়ারকে সুবিধা দেয় এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের বাজার থেকে উচ্ছেদ করে, তা দীর্ঘমেয়াদে ভোক্তা ও দেশের সার্বিক অর্থনীতির ক্ষতি করবে।

একজন বাজার বিশ্লেষক পর্যবেক্ষণ করে বলেন, “নিরাপত্তা ও রাজস্ব রক্ষার উদ্দেশ্য যাচাইযোগ্য, কিন্তু প্রয়োগপ্রক্রিয়া যদি স্বচ্ছ না হয় এবং ওপেন মার্কেট সুরক্ষা না দেয়, তাহলে এটি নতুন প্রকার বাজারকেন্দ্রিক প্রবণতা তৈরি করবে।

প্রশাসনিক ভাবনা ও চাপও আছে

কয়েকজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও প্রশাসক-পরামর্শক জানান, নির্বাচনের আগে বড় ধরনের নিয়ন্ত্রক পরিবর্তন দ্রুত প্রয়োগ করা হলে তা নাগরিকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পারে, এবং এমন সিদ্ধান্তগুলোকে রাজনৈতিক প্রসঙ্গে বিশ্লেষণ করা স্বাভাবিক। তারা মনে করিয়ে দেন, নীতিনির্মাণে সময়সীমা, ট্রায়াল-পিরিয়ড ও পর্যায়ক্রমিক প্রয়োগ রাখা হলে বাজার ও নাগরিকদের উপর নেতিবাচক প্রভাব অনেকটাই কমানো সম্ভব।

সম্ভাব্য সমাধানগত ধাপ (বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব)

> BTRCর এনওসি (NOC) নীতির পরিবর্তে একটি স্বচ্ছ অনুমোদন মেকানিজম চালু করা

> আমদানি শুল্ক ও কর কাঠামো পর্যালোচনা করে প্রতিবেশী দেশ ও স্থানীয় উৎপাদনকারীদের  অনুরুপ প্রতিযোগিতামূলক হার নিশ্চিত করা।

> একটি অন্তর্বর্তী সময়ে, দেশের সকল মোবাইল ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনা  ও পাবলিক অবজারভেশন পিরিয়ড রাখা।

> ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য বিটিআরসি ইমপোর্ট লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসা।

উপসংহার

নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অবস্থান অনুযায়ী, NEIR বাস্তবায়নের লক্ষ্য অ-নিবন্ধিত ও ক্লোন ডিভাইসগুলোর বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা এবং ব্যবহারকারীর ডাটা সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কিন্তু নীতির প্রয়োগপদ্ধতি ও সময়নির্ধারণের ওপর যদি প্রয়োজনীয় স্টেকহোল্ডার পরামর্শ না নেয়া হয়, তাহলে তা বাজারে অনিশ্চয়তা এবং আর্থিক ক্ষতির কারণে বৃহৎ সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারে।

বর্তমান সময়েই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে (বিটিআরসি, এনবিআর, বণিক-সমিতি ও ব্যবসায়ী সংগঠন) আন্তঃকর্মযোগ করে দ্রুত আলোচনা আয়োজন করা অনিবার্য মনে করছেন বিশ্লেষকগণ।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.