September 21, 2024, 2:29 am


আমিনুল ইসলাম শামীম

Published:
2024-05-21 14:39:59 BdST

শিক্ষিত ভূমিহীন প্রজন্ম - দ্বিতীয় পর্ব


পৃথিবীর প্রত্যেকটা উন্নত দেশ নিজের কৃষিকে আধুনিক করার মাধ্যমে অর্থনীতির মজবুত ভিত শুরুতেই কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। রাষ্ট্র তার ভূমি ব্যবস্থাপনা, কারিগরি সক্ষমতা এবং ধারাবাহিক গবেষণার ফলাফল কাজে লাগিয়েই আজকের উন্নত রাষ্ট্র হয়েছে।
 
উল্লেখ্য যে, এই অর্জনটি উক্ত দেশগুলোর নিজস্ব প্রয়োজন ও পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হয়েছে। ১৯৩০-এর দশকে আমেরিকায় মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার ষাট শতাংশ নিয়োজিত ছিল কৃষিতে এবং বর্তমানে সেই সময়ের চাইতে বহুগুণ উৎপাদন করেও বর্তমান মোট জনসংখ্যার মাত্র ৬ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। তাদের সফলতার অন্যতম কারণ তাদের ভূমি ব্যবস্থাপনা। দেশের বিশাল আয়তনের অব্যবহৃত সমতল ভূমি আধুনিক উচ্চ উৎপাদনশীল কৃষি যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির কারণে সহজেই ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠে। আমাদের দেশের ভূমির গঠন ও ব্যবস্থাপনা এবং সেইসঙ্গে জনসংখ্যার আধিক্য একটি সমস্যা, যা এখন জটিল রূপ ধারণ করেছে, এখান থেকে বেরুতে হলে দেশের ভূমির উপযোগী উচ্চ উৎপাদনশীল কৃষি যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির আবিষ্কার আমাদেরকে দেশে বসেই করতে হবে। ভরসা করার মতো কার্যকর কোনো লক্ষণ যদিও আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
উপযুক্ত লক্ষণ যদি এখন চোখে পরেও তবে তার ফলাফল পাওয়ার জন্য আমাদেরকে হয়তো কয়েক যুগ অপেক্ষা করতে হবে। লাগসই উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে টেকসই উন্নয়নের দিকে ধাবিত হওয়ার প্রয়োজন সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারায় এখন উন্নয়নের ব্যাপারে গবেষণা বহুধা বিস্তৃত ও জটিল বিষয়ে মনোযোগী।
 
স্বাধীন অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের খাদ্য উৎপাদনের সক্ষমতা অনেক বড়ো নিয়ামক শক্তি। বহু শতাব্দী ধরে অর্জিত মহামূল্যবান কৃষিজ্ঞান হারিয়ে ফেলার কারণে আমরা একটা পরাধীন পরনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দিকে ক্রমশ ধাবিত হচ্ছি। বীজ ও কৃষি যন্ত্রপাতি বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হতে শুরু করেছে। কৌশলগত জায়গা থেকে যদি ভাবি, একটা বিষয় মনে হয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে,- এইসব বহুজাতিক উপকরণ কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় আমাদের জন্য উপকারী নয়। অন্যতম কারণ, উপকরণের সিংহভাগ দেশের পরিবেশ, জলবায়ু ও ভূমি ব্যবস্থাপনাকে বিবেচনায় নিয়ে উৎপাদন করা হয় নাই। ঐতিহ্যগতভাবে অর্জিত মহামূল্যবান কৃষিজ্ঞান একবার হারিয়ে ফেললে ফেরত পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য প্রাথমিকভাবে সুপরিকল্পিত ও কার্যকর উপায়ে কৃষি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা জরুরি।
আমার পরিচিত জগতে অনেকেই সফলভাবে দেশে-বিদেশে জ্ঞানের উচ্চ শিখরে নিজের অবদান রেখে চলছেন। তারা প্রত্যেকে ছোটবেলা থেকে কৃষিজ্ঞান পারিবারিক আবহ থেকে পেয়েছিলেন। বাল্যকালের এই শিখন পরে কাজে দিয়েছে। শরীরের সঙ্গে মানসিক সক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিলেন বলেই পরবর্তীতে নানা প্রতিকূলতা ও অপ্রতুলতা জয় করে সফল হতে পেরেছেন, নিজেরা থাকতে পেরেছেন অবিচল।
তাই বলছিলাম, আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী কৃষিজ্ঞান আমাদের এক মহান সম্পদ।
দুর্ভাগ্য,বড় হেলায় আমরা হারিয়ে ফেলছি এ অমূল্য ধন।
 
পর্যটক বিজ্ঞানী নামে নয়া এক জাত দেশে জন্ম নিয়েছেন। নতুন ভ্রমণ সংস্কৃতি নীতিনির্ধারণী মহলে ব্যাপক জনপ্রিয় এখন। ভবন নির্মাণে লিফট লাগবে, চলেন বিদেশ গিয়ে লিফট দেখে আসি। শহরের সৌন্দর্য বর্ধন করা দরকার, চলেন সিঙ্গাপুর দেখে আসি। বেড়াতে গেলেন, দেখলেন আর তার উন্নয়নের কৌশল বুঝে ফেলবেন, এসেই ওটা দেশে অ্যাপ্লাই করে ফেলবেন...ব্যাপারটি এত সহজ না।
তার মানে বিদেশ সফরের আমি বিরোধী নই। অন্য দেশের উন্নয়ন পদ্ধতি জানার জন্য বাইরে প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার্থে পাঠানোর যৌক্তিকতা রয়েছে। কিন্তু সেটার সঠিক ভিত্তি ও কারণ থাকতে হবে। অন্যথায় প্রশিক্ষণ ও পড়াশোনা যতটুকু সম্ভব হলো এবং সেইসঙ্গে তাদের সংস্কৃতি জানার সুযোগও থাকলো ইত্যাদি অজুহাতে বিদেশ যাওয়া-আসাই হবে, কাজের কাজ কিছু মিলবে না।
কলা গাছের আঁশ দিয়ে যদি পাট গাছের আশের কাজ হইত তাইলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষক নাইলা ক্ষেত করত না। যারা এইরকম কাজে যাচ্ছেন তাদের আর কি অপরাধ! সঠিক উন্নয়ন- দর্শন ছাড়া এরকম বালখিল্য কাণ্ড থামানো সম্ভব নয়।
 
আমি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করি। পেশাদার লেখক নই। সাংবাদিক বা পেশাদার গবেষকও না। ভার্সিটিতেও পড়াই না। দেশকে ভালবাসি, নিজেকে রাজনীতি সচেতন বলে ভাবি, আমার কথাগুলো বলার কারণ সেটাই।
এইসব বিষয়ে পেশাদার লেখক-গবেষকরা এগিয়ে আসবেন এইটা চাই বলেই এত কথার অবতারণা। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমার এই চাওয়াটা আশা করি বেশি নয়।
আমার ভাবনাটি এখানে সরল ও স্পষ্ট। আশা করি পাঠকরা এর সঙ্গে নিজের ভাবনা যুক্ত করবেন, যেনো আমরা সবাই মিলে এই বিষয়টি নিয়ে আরো ভাবতে, তর্ক করতে পারি।
কৃষকের জীবনমান উন্নতির জন্য আমাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ পরিকল্পনা নিতে হবে। গ্রামের প্রাইমারি ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর বিশেষ যত্ন ও কৃষি সংশ্লিষ্ট বিশেষ কারিকুলাম এবং বাস্তবিক কৃষি কাজের সময় ও স্কুলের সময়সূচির মধ্যে উপযুক্ত সমন্বয়ের মাধ্যমে পাঠদানের সময়সূচী নির্ধারণ করতে হবে।
 
আমাদের গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা একজন ছাত্র যে পরিমাণ শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারে, শহরে বেড়ে ওঠা ছাত্রদের অধিকাংশের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। যেকোন ব্যক্তির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, কর্মক্ষেত্রে অবদান রাখার সক্ষমতা বিশেষ চারটি মানসিক গুণের ওপর নির্ভর করে :
IQ (intelligence quotient),
SQ (social quotient),
AQ (adversity quotient), EQ (emotional quotient)।
এই চারটা গুণ ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতিতে পরিচর্যার পাশাপাশি আমরা গ্রামীণ স্কুলগুলোতে উপযুক্ত শিক্ষকের মাধ্যমে পাঠদান নিশ্চিত করতে পারতাম, এই পৃথিবীর সফল রাষ্ট্রের কাতারে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়ার মতো উপযুক্ত মানবসম্পদ পেতাম। এই গুণগুলার পরিচর্যা করতে সক্ষম স্কুল,এমনকি উন্নত বিশ্বে বিরল এবং খুবই ব্যয়বহুল। আমার জানা মতে বাংলাদেশে এরকম হাতে গোনা তিন চারটে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আছে যা খুবই ব্যয়বহুল।
 
ছাত্রদের গড়পড়তা মাসিক বেতন লক্ষ টাকার উপরে এবং ৯৯% পরবর্তীকালে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠিত।
আহারে বেকুব রাষ্ট্র , একটা কার্যকর পরিকল্পনার মাধ্যমে,আমাদের দেশজ উচ্চ মানসম্পন্ন ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ সংস্কৃতির সাথে ভালো মানের শিক্ষকের পাঠদানের মিশেলে এইরকম উচ্চমান সম্পন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করতে পারতাম হাজারে হাজার স্কুলগুলার মাধ্যমে , যে-প্রজন্ম নিশ্চিতভাবে একটা অতি উন্নত জাতি- রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হতো।
আমাদের প্রতিষ্ঠিত ধনীরা প্রায় সবাই শহরে বাস করে। তাদের সীমাহীন ত্যাগ ও পরিশ্রমের ফসল বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, তাদের পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তাদের মতো নিরাপদ না। ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে এইসব প্রতিষ্ঠানের উপযুক্তভাবে টিকে থাকা অথবা আরও বড় হয়ে ওঠার উদাহরণ সীমিত। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই তারা তাদের সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষার আশায় উন্নত বিশ্বে প্রেরণ করেন। এই যে ভিন্ন সংস্কৃতিতে উচ্চশিক্ষা নেওয়া সন্তানেরা দেশীয় সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঠিক নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি।
ব্যর্থতার দায়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক সম্ভাবনার ক্ষতি শুধু ব্যক্তির না, রাষ্ট্রেরও।
 
বর্তমানে রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের মোট সম্পদের আশি শতাংশের উপরে এই ধনিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া রাষ্ট্রের প্রধানতম কর্তব্যের একটা।
এইসব প্রতিষ্ঠানের মালিকরা তাদের নিজস্ব স্বার্থে যেকোন একটা গ্রামে ভালো স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের সন্তানদের কমপক্ষে মাধ্যমিকের আগে ৫ বছর কোন কৃষকের সাথে বড় হওয়ার সুযোগ করে দিতে পারলে এই সন্তানরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম নেতৃত্ব গুণ অর্জনের মাধ্যমে তাদের প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করার মাধ্যমে শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারতো।
চিন্তা করতেই অবাক লাগে আমরা মানুষকে গালি দিই, চাষা, বলে।।। কী আত্মঘাতী সংস্কৃতি!!!
 
সুচিন্তিতভাবে আমাদের কিছু উদ্যোগ নিতে হবে, যেমন ভালো রাস্তা, ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিদ্যুতের সুব্যবস্থা ও মানসম্পন্ন চিকিৎসা সুবিধা গ্রামীণ জনপদ অগ্রাধিকার পাবে। চিন্তা করা যায় ফলাফল কত সুন্দর হতো!
কৃষকদের জন্য এমন একটা ব্যাংক হবে যেখানে কৃষকরা যেই লভ্যাংশে টাকা জমা করবে,তার চাইতে কম লভ্যাংশ টাকা ঋণ নিতে পারবে।
ঋণ নিতে পারবে জমানো টাকার সমপরিমাণ। সামান্য ভর্তুকি লাগবে, এইতো।
ওইটা ভর্তুকি না, রাষ্ট্রের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে, আমি বলব, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ।
চলবে।
 

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা