September 20, 2024, 6:30 pm


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2024-07-13 23:15:20 BdST

৮২ হিসাবে লেনদেন ১৩৮ কোটি টাকাসওজ প্রকৌশলী জাহাঙ্গীরের ব্যাংকে শত কোটি টাকার লেনদেন


অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগে সড়ক ও জনপথ বিভাগের এক কর্মকর্তার ৭টি ব্যাংক হিসাবে থাকা ৩০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জব্দ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ।

সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১২ বছরে অভিযুক্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের ৮২টি ব্যাংক হিসাবে ১৩৮ কোটি টাকা লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছেন তারা।

আলাদিনের চেরাগ যেন হাতে পেয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম। তার ব্যাংক হিসাবে ঘুরছে শতশত কোটি টাকা। মনে হচ্ছে তিনি যেন টাকা বানানোর এক মেশিন আবিষ্কার করেছেন। তার ৭৭টি এফডিআর এবং ৮২টি ব্যাংক হিসাবে এত বিপুল অংকের টাকা কিভাবে এলো তা এখন এক বিরাট প্রশ্ন।

অনেকে বলছেন, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সড়ক উন্নয়ন অংশের প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) দায়িত্ব পাওয়ার পরই তার অর্থ-সম্পদ বেড়েছে বিদ্যুৎগতিতে। গত ১০ বছরে তিনি বেতন পেয়েছেন মাত্র ৯৮ লাখ টাকা। অথচ তার নামে ৭৭ এফডিআরসহ ৮২ ব্যাংক হিসাবে লেনদেন করেছেন ১৩৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

তার এই বিপুল অর্থ লেনদেন ধরা পড়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্তে।

প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলমের নাম সামনে আসে বিএফআইইউ এর অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক অর্থ লেনদেনের সতর্ক সংকেত পাবার মাধ্যমে। এরপর ওই হিসাবের সূত্র ধরে তদন্তে নামার পরই প্রকৌশলী জাহাঙ্গীরের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়টি পরিষ্কার হয় বিএফআইইউ এর কাছে।

একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে তার হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের চিত্র স্বাধীন আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর প্রতিবেদন তৈরি করে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্তের তাগিদ দেওয়া হয়।

জাহাঙ্গীর আলমের অপরাধের বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধান ও তদন্তপূর্বক আইনি ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি বাংলাদেশের প্রচলিত আইন, বিধিবিধান ও নিয়মাবলী লঙ্ঘন করে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন। এই অর্থ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা, স্থানান্তর ও ব্যক্তিগত সম্পদে রূপান্তরের বিষয়টি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ২(শ)(১) ধারা মোতাবেক ‘দুর্নীতি ও ঘুস’ মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ। একই সঙ্গে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ আয়কর বিবরণীতে প্রদর্শন না করে কর ফাঁকির বিষয়টি একই আইনের ২(শ)(১৯) ধারা মোতাবেক মানি লন্ডারিং সম্পৃক্ত ‘কর সংক্রান্ত অপরাধ’।

বিএফআইইউ এর মতে, এখানে বহুবিধ দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে। দেরিতে হলেও বিএফআইইউ যেহেতু এটা চিহ্নিত করেছে এখন দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার সুযোগ হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএফআইইউ'র এক কর্মকর্তা বলেন, এখানে দুর্নীতি সংক্রান্ত অপরাধের কয়েকটি উপাদান আছে। একটি হচ্ছে, তার বৈধ আয়ে এ ধরনের সম্পদ বা অর্থের মালিকানা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। এতএব এখানে পরিষ্কারভাবেই দুদক আইনের সংজ্ঞা অনুযায়ী দুর্নীতি হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, তিনি এসব অর্থ সম্পদ আয়কর রিটার্নে উল্লেখ না করে প্রতারণা করেছেন। অর্থাৎ তিনি নিজেই নিজের অপরাধ স্বীকার করেছেন। কারণ তিনি যে অর্থ সম্পদ অর্জন করেছেন তা যেহেতু বৈধ নয়, তাই তিনি আয়কর রিটার্নেও দেখাননি।

বিএফআইইউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাহাঙ্গীর আলম সরকারের দায়িত্বশীল পদে কর্মরত। দুর্নীতির মাধ্যমে তার অবৈধ আয়ের অর্থ এসব ব্যাংক হিসাবে লেনদেন হতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ৭৭টি স্থায়ী আমানত হিসাবে এখনো ৩০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জমা থাকলেও তিনি আয়কর বিবরণীতে মাত্র ৪ কোটি ১০ লাখ টাকার নিট সম্পদ প্রদর্শন করেছেন। এতে আয়কর ফাঁকির মাধ্যমে তিনি অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মালিক হয়েছেন বলে প্রতীয়মান হয়।

ব্যাংক হিসাবে দেখা যায়, ২০১২ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত হিসাবগুলোতে ৮৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা জমা এবং ৫৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা তোলা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকের ৭ অ্যাকাউন্টে জমা আছে ৩০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। যদিও তিনি বিভিন্ন সময়ে ঠাকুরগাঁও, গোপালগঞ্জ ও রাজশাহীতে কর্মরত ছিলেন।

তথ্যমতে, জাহাঙ্গীর আলম এখন মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সড়ক উন্নয়ন অংশের প্রকল্প পরিচালক। ব্যাংক বিবরণীর হিসাবে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে প্রকল্প পরিচালক হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তার নামে বেতন ভাতা বাবদ জমা হয়েছে ৯৮ লাখ টাকা। অথচ, তার নামে ৭৭টি এফডিআরসহ মোট ৮২ আমানত হিসাবে (৫টি সঞ্চয়ী ও ৭৭টি স্থায়ী আমানত) লেনদেন হয়েছে ১৩৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, জাহাঙ্গীর আলমের ব্র্যাক ব্যাংকের বসুন্ধরা শাখার সঞ্চয়ী হিসাবে বিভিন্ন সময় ২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা জমা হওয়ার পর সব টাকাই তুলে নেওয়া হয়। একইভাবে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের কর্পোরেট শাখার সঞ্চয়ী হিসাবে বিভিন্ন সময় ১২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা জমা করার পর তা তুলে নেন। ২০২১, ২০২৩, ২০২৪ সালে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের গুলশানে কর্পোরেট শাখায় ১৮টি এফডিআর এবং একটি সঞ্চয়ী হিসাব খুলে জমা করেন ৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। সমপরিমাণ টাকা এখনও এসব হিসাবে জমা আছে।

তথ্য মতে, ২০১২ সালে জাহাঙ্গীর আলম আরেকটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রগতি সরণি শাখায়। এই হিসাবে ৩৮ কোটি টাকা জমা করা হয়। তুলে নেওয়া হয়েছে ৩৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ১১টি এফডিআর এবং ডিপিএস হিসাব খুলে ৮ কোটি ৮ লাখ টাকা জমা করা হয়। সমপরিমাণ টাকা এখনও জমা আছে।

অন্যদিকে, ২০২৪ সালের জুন-জুলাইয়ে আইডিএলসি ফিন্যান্স পিএলসি উত্তরা শাখায় ৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকার ১৭টি এফডিআর করেন তিনি। এসব টাকা এখনও স্থিতি আছে। ২০২৩, ২০২৪ সালে ১৩ কোটি ৮ লাখ টাকার ৩১টি এফডিআর করেছেন ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স পিএলসি গুলশান শাখা এবং প্রিন্সিপাল শাখায়। এগুলো এখনও স্থিতি আছে।

২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সোনালী ব্যাংকের রাজশাহী, গোপালগঞ্জ, ঠাকুরগাঁ এবং ঢাকার বারিধারা শাখায় খোলা হিসাবে ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা জমা করে তা তুলে নেন জাহাঙ্গীর আলম। এসব হিসাবে তিনি মোট ১৩৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা লেনদেন করেন। জমা থাকা ৩০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জব্দ করেছে বিএফআইইউ।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে এত বিপুল অংকের লেনদেন বিস্ময়কর।এগুলো অবশ্যই অস্বাভাবিক টাকা। এটা হওয়ার কথা নয়। এখন এটা কীভাবে হলো, তিনি কীভাবে রোজগার করলেন, অথবা এই টাকাটার উৎস কি, বিএফআইইউ নিশ্চয়ই দেখছে এখন। বিএফআইইউ যখন জব্দ করেছে, তখন ধরেই নিতে হবে এটি সন্দেহজনক লেনদেন।’

তিনি বলেন, ‘বিএফআইইউ এই বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন করে থাকলে দায়িত্বশীল সংস্থার উচিত তা আমলে নিয়ে তদন্ত করা। তদন্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অর্থ উপার্জনে অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিএফআইইউ’র উক্ত প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, জাহাঙ্গীরের স্ত্রী ও সন্তানদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের অনুসন্ধান চলছে।

চাকরির বেতন-ভাতা ব্যতীত বৈধ অন্য কোনো আয়ের উৎস না থাকা সত্ত্বেও ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের আয়কর রিটার্নে জাহাঙ্গীর আলমের ৪ কোটি ১০ লাখ টাকার নিট সম্পদ থাকা অস্বাভাবিক মর্মে এর উৎস চিহ্নিত করা প্রয়োজন। এছাড়াও তিনি কর ফাঁকির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন, এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক বলে মনে করে সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সংস্থা।

এই বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সড়ক উন্নয়ন অংশের প্রকল্প পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বিএফআইইউর আমাকে নিয়ে এ ধরনের প্রতিবেদনের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। এটা হয়ে থাকলে তারা (বিএফআইইউ) নিশ্চয়ই কোথাও ভুল করেছে। আমার এত অর্থ নেই। এত অর্থ থাকলে আর চাকরিই করতাম না। আমার এত অর্থ থাকার তথ্য ঠিক না।"

নিজের বিরুদ্ধে উত্থাপিত এসব অভিযোগের বিষয়ে তার কিছু বলার নেই বলেও জানান জাহাঙ্গীর আলম।

এখানেই শেষ নয়, সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত সরকারী কর্মকর্তা মতিউর ও এই জাহাঙ্গীরের মত আরো একাধিক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা রয়েছেন সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরে। সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরে অনেক নির্বাহী প্রকৌশলীও এখন এক একজন টাকার মেশিন।

পুরো অধিদপ্তরটিই যেন জাহাঙ্গীর ও মতিউর দ্বারা বেষ্টিত। এদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির পর্যাপ্ত তথ্য ও নথিপত্র সম্প্রতি দ্যা ফিন্যান্স টুডে হাতে এসেছে। এই বিষয়ে এফটি টীমের গভীর অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন দ্রুততম সময়ে প্রকাশিত হবে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা