September 20, 2024, 4:34 pm


সালাহউদ্দিন মিঠু:  

Published:
2024-07-31 11:36:32 BdST

সর্বশান্ত মধ্যবিত্তের শেষ সম্বলঅনুমোদনহীন আবাসন কোম্পানীর প্রতারণা 


  • মিথ্যা স্বপ্ন বিক্রি
  • অর্থ আত্মসাত
  • বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া
  • বুকিং বাণিজ্য
  • প্রাকৃতিক জলাভূমি ভরাট

মধ্যবিত্তরা সারাজীবন স্বপ্ন দেখে- ‘একটি বাড়ি তৈরি, এক খন্ড জমির উপর’। ফলে সাধ ও সাধ্যের সমন্বয়ে তার নিরন্তর লড়াই অবিরাম। আর এই লড়াইয়ের মাঠেই প্রতারণার ফাঁদ পেতে চটকদার বিজ্ঞাপন দেখিয়ে বসে থাকে আবাসন প্রকল্পের নামে প্রতারকরা। যাদের কাছে স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন লাখো মানুষ।

রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছে ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক (ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে) ও পদ্মা সেতু। আস্তে আস্তে ঢাকা মাওয়া হাইওয়ে এক্সপ্রেসওয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পুজি করে  কেরানীগঞ্জে ৯ ইউনিয়নে ৮০টি আবাসন প্রকল্পের হিড়িক বসেছে। ‘স্বপ্ন নয় সত্যি’ এমন চূড়ান্ত নিশ্চয়তাই তাদের মার্কেটিং পলিসি। বিপণনকর্মীদের মনোমমুগ্ধকর উপস্থাপনায় সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করা হয় প্লট, ফ্ল্যাট, ডুপ্লেক্স এবং কনডোমিনিয়াম ক্রয়ে। বাসস্থান নিশ্চিত করা নয়। মূল টার্গেট যেকোনো প্রকারে গ্রাহকের পকেট খালি করা। মধ্যবিত্তের সারাজীবনের সঞ্চয়কে কুক্ষিগত করাই ভূমিদস্যুদের মুল লক্ষ্য। অনেকে কালো টাকা সাদা করার জন্যও এখানে ওত পেতে বসে থাকে।সরকারি বেসরকারী দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতা এবং চটকদার প্রচার-প্রচারণাই প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজি। নামে-বেনামে প্রায় শতাধিক আবাসন প্রকল্পগুলোর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এর নীতি বহির্ভূত এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না নিয়েই তারা দেধারছে প্রকল্প পরিচালনা করছে। গভীর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে অর্থ আত্মসাত, বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া, অর্থ পাচার, প্রাকৃতিক জলাভূমি ভরাট বেআইনি নানা কার্যকলাপ।

কেরানীগঞ্জসহ ধলেশ্বরী ব্রিজের পর পদ্মা মুখী সিরাজদিখান, শ্রীনগর, নিমতলা ঘুরে দেখা গেল, পুরো উপজেলায় আবাসন আর হাউজিং প্রকল্পের হিড়িক পড়ে গেছে। কোথাও কোথাও ড্রেজিং করে নিচু জমিতে বালু ফেলে ভরাট করে প্লট তৈরির কাজ চলছে। মাঠের পর মাঠ শত শত সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে অসংখ্য আবাসন।

কেরানীগঞ্জে ৯ ইউনিয়নে ৮০টি আবাসন প্রকল্প:
কেরানীগঞ্জে ১২টি ইউনিয়ন—হযরতপুর, কলাতিয়া, তারানগর, রোহিতপুর, শাক্তা, কালিন্দী, বাস্তা, তেঘরিয়া, শুভাঢ্যা, জিনজিরা, কোন্ডা ও আগানগর। শুধু হযরতপুর, জিনজিরা ও আগানগরে কোনো আবাসন প্রকল্প নেই। উপজেলা প্রকৌশল বিভাগের অনুমান, অন্য ৯টি ইউনিয়নে ছোট–বড় প্রায় ৮০টির মতো আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি আবাসন প্রকল্প হয়েছে তারানগর ইউনিয়নে, প্রায় ৪৫টি। মাইলের পর মাইলজুড়ে বিভিন্ন আবাসন কোম্পানির শত শত সাইনবোর্ড। কোনো কোনো আবাসনে বালু ভরাট চলছে। কোনোটিতে মাটি সমান করে পথ ও প্লট তৈরির কাজ চলছে। তবে সাইনবোর্ড স্থাপনের জন্য  এই জায়গাগুলো নেয়া হয় ভাড়ায়। তাদের কাছে যারা সাইন বোর্ড স্থাপনের জন্য কৃষিজমি ভাড়া দেয় তারাও কখনও কখনও জমি হারানোর আশঙ্কায় রাতের ঘুম হারাম হয়।

এখনো অনেক প্রকল্পের অনুমোদন নেই:
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবাসন প্রকল্প গ্রহণে হাউজিং কোম্পানিকে সাতটি শর্ত পূরণ করতে হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে– কোম্পানির নামে ১০ একর জমি থাকতে হবে, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে, পরিবেশ অধিদপ্তরের তিন ধাপের ছাড়পত্র থাকতে হবে, জেলা প্রশাসনের দায়মুক্তি সনদ নিতে হবে, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশিরভাগ আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড টাঙানো, তারা কেউই এই সাত শর্ত পূরণ করেননি।

প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ অনুযায়ী, সরকার ঘোষিত জলাধার যে কোনো পরিস্থিতিতেই ভরাট করা নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ওই জলাধারে কাঠামো নির্মাণ, জমির উন্নয়ন, বালু বা কাদা উত্তোলন করে পানির গতিপথ বন্ধ, পরিবর্তন অথবা পরিবর্তনের চেষ্টা করতে পারেন না।

কিন্তু এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ঘেঁষে কেরানীগঞ্জ, সিরাজদিখান, আড়িয়ল বিলের হাসাড়া, ষোলঘর ও কেওয়াটখালী মৌজায় আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড লাগানো বেশ কয়েকটি হাউজিং কোম্পানি বিলের কৃষিজমি ভরাট করে চলেছে। কেউ কেউ কৃষকের জমি ভাড়া নিয়ে তাতে আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড লাগিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে।

ফুটপাত থেকে কোটিপতি:
অপরাধের ধরন পাল্টে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্রতারণার ভয়াবহ জাল। চাকরি দেয়ার নামে প্রতারণা, পে-অর্ডার প্রতারণা, বুকিং বাণিজ্য, জমি দখল পদে পদে প্রতারণার ফাঁদ। স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক চক্র ভাগ-বাঁটোয়ারার লোভে যুক্ত হয়ে দুই পক্ষের স্বার্থ এক হলে তারা যথেষ্ট শক্তি নিয়ে জমিদখল, জলাভূমি ভরাট করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখিয়ে বিপণনকর্মীদের মনোমমুগ্ধকর উপস্থাপনায় আবাসন প্রকল্পের কর্নধার’রা বিপুল অর্থ লুপিয়ে মধ্যবিত্তের সারাজীবনের সঞ্চয়কে কুক্ষিগত করছে। নিজেদের বিলাসবহুল জীবন, কোটি টাকার গাড়ি, ছেলেমেয়েকে বিদেশে পড়ালেখা করানো, বিদেশ ভ্রমন, শুধু তাই নয়- নিজ প্রতিষ্ঠানে কাজ করা এমন অনেক আবাসন প্রতিষ্ঠান আছে যাদের বিপননকর্মীদের এক মাসের বেতন চার মাস পর দেওয়া হয় তাও আবার নানা যল্প কল্পনার মধ্য দিয়ে- এদের মধ্যেও অনেককে বেতন থেকে বঞ্চিত করা হয়।  আবাসন ব্যবসার নামে ‘ফুটপাত থেকে কোটিপতি’ বনে যাওয়া আবাসন প্রকল্পের কর্নধারদের বিরুদ্ধে ডজনখানের অভিযোগ রয়েছে গোয়ান্দা ডায়রির অনুসন্ধানী টিমের কাছে। 

বুকিং বাণিজ্য :
ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক ঘেঁষে আশপাশের মৌজাগুলোতে আবাসন প্রকল্পগুলোতে আইন ও বিধিবিধান না মেনে প্রকল্প পরিচালনা করে মাঝেমধ্যে আয়োজন করে ‘বর্ণাঢ্য আবাসন মেলা’র। ৫০০-১০০০ বিঘা জমি লে-আউটে দেখিয়ে প্রকল্পের আকার  ৩ কাঠা, ৫ কাঠা ও ১০ কাঠা আয়তনের প্লট দেখিয়ে বুকিং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত হয়। একই প্রকল্পে ডুপ্লেক্স, ট্রিপ্লেক্স, ভিলা এবং কন্ডোমিনিয়ামের বুকিংও নেয়া হয়। যেখানে আবাসন প্রকল্প করতে গেলে প্রথম যেই শর্ত মানতে হয়- কোম্পানির নামে ১০ একর জমি থাকতে হবে, সেখানে অনেক কোম্পানীর ২০ শতাংশ জমিও নেই। অথচ লে-আউটে শত শত বিঘা বিস্তৃত জমি  প্রদর্শিত থাকে। বিঘা বিঘা কৃষিজমির উপর সাইনবোর্ড টাঙিয়ে বালু ভরাট করে গ্রাহকের কাছ থেকে বুকিংমানি নিয়ে একই প্লট ৩ বার বিক্রিও করে। অন্যের মালিকাধীন কৃষিজমিকেও প্রকল্পের আওতাভুক্ত দেখানো হয়। গুগল ম্যাপ এবং লে-আউটের কাগুজে অবস্থান দেখিয়ে নেয়া হয় বুকিং মানি। বুকিং বাণিজ্যে কোম্পানির অ্যাকাউন্টে টাকা নেয়া হলেও যে প্লটটি পছন্দ করে গ্রাহক বুকিং দিচ্ছেন কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় সেটির দলিলই কোম্পানির নামে নয়।

আবাসন প্রকল্পের পদে পদের প্রতারনার ফাঁদের মুখ উন্মোচন করতে আমাদের অনুসন্ধানী টিম কাজ করছে, পরবর্তী সংখ্যায় অনুমোদনহীন আবাসন প্রকল্পগুলোর থলের বিড়াল ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে পর্যায়ক্রমে। 

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা