September 20, 2024, 12:20 pm


শাহীন আব্দুল বারী

Published:
2024-08-09 07:57:20 BdST

হুকুমের গোলাম হতে আর রাজী নয় পুলিশ


পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্তা ব্যক্তিদের ফাঁদে পড়ে কোন পুলিশ সদস্য রাজনৈতিক সরকারের হুকুমের গোলাম হতে আর রাজি নয়। পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা উচ্চবিলাসী এবং অপেশাদার কিছু সদস্যের প্ররোচনায় গোটা পুলিশ বাহিনীর বেহালদশা ও করুণ পরিণতি। এ অভিযোগ মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের।

সূত্রমতে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে দুষকৃতকারীদের হাতে অসংখ্য পুলিশ সদস্য হতাহতের ঘটনায় সচেতনা বৃদ্ধি এবং অনুশোচনা থেকে গোটা পুলিশ বাহিনীর মধ্যে এ আওয়াজ উঠেছে। তারা মিডিয়ার কাছে অকপটে স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেছেন,  পুলিশ সদস্যদের উপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ, পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবি প্রধান ডিআইজি হারুন, এডিশনাল ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকার ও ডিবির ডিসি মোরশেদ সহ গোপালগঞ্জ বাহিনী। এই বাহিনীর  নেতৃত্বে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও দায়ী করেছেন পুলিশ সদস্যরা। এই সিন্ডিকেটের হুকুমের গোলাম পুলিশ সদস্যদের বেহাল দশা এবং করুণ পরিণতির জন্য উচ্চভিলাসী এসব কর্মকর্তারা এখনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। এর অংশ হিসেবে পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্বে থাকা উচ্চাবিলাসী ও অপেশাদার কিছু সদস্যের প্ররোচনায় এখনো দাবী আদায়ের নামে নানা ষড়যন্ত্র করছে একটি চক্র। তারা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স, বিভিন্ন ব্যারাক ও জেলায় নানামুখী উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রচার করে আসছে। এমনকি তারা ইউনিফর্ম না পরাসহ কর্মবিরতী পালন করছে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। চিহ্নিতদের মধ্যে পুলিশ কনস্টেল সোয়াইবুর রহমান জয়কে নেতৃত্বে থাকতে দেখো গেছে। সে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের উস্কানি দিচ্ছে।

 সাধারণ পুলিশ সদস্যদের ভাষ্য, ওএসডি হওয়া সাবেক পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের প্রেতাত্মা এই জয়। সে হাবীবের গৃহপালিত হিসেবে পরিচিত। এই কনস্টেবল ‘পুলিশ থিয়েটার’এর সদস্য। হাবিবুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ‘অভিশপ্ত আগস্ট’ নাম মঞ্চ নাটকে ‘শেখ কামাল’-এর চরিত্রে অভিনয় করে জয়। এখনকার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা তৈরির উদ্যোগ হিসেবে তার নাম দিয়ে উস্কানিমূলক নানা বার্তা পাঠানো হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের কাছে। বিভিন্ন জনের হোয়াটসআপ ম্যাসেঞ্জারেও এই বার্তা পাঠিয়েছেন জয়।

বার্তা পাওয়া রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের একজন এএসআই সহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য জানান, নাট্যদলের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন সময়ে কমিশনারসহ অনেক উচ্চ পদস্থদের কাছাকাছি থাকতেন জয়। সোয়াইবুরের নাম দিয়ে আওয়ামী পুলিশের প্রভাবশালী কয়েক কর্মকর্তা পেছন থেকে এসব করাচ্ছেন।

অপর এক সাব ইন্সপেক্টর বর্তমান অস্থিরতার জন্য পুলিশের গোপালগঞ্জ বেল্টের কর্মকর্তাদের এই উস্কানির জন্য দায়ী করে বলছেন, ‘হাবিব স্যার অনেক লোক নিয়োগ দিয়ে গেছেন। তিনি নিয়োগ পদোন্নতিতে বেশুমার জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। করেছেন ঘুষ বাণিজ্য। পুলিশের শৃঙ্খলা ফিরলে, সংস্কার হলে হাবিব স্যারদের আর আধিপত্য থাকবে না। হাবিব স্যার সহ অনেককেই জেলেও যেতে হতে পারে। বিচারের মুখোমুখি হতে হবে উচ্চাবিলাসী অনেক অপেশাদার পুলিশ কর্মকর্তার।

সূত্রমতে, অতিউৎসাহী ও উচ্চবিলাসীরা এখন বিচারের ভয়ে শঙ্কিত। তাই বিষয়গুলো বুঝতে পেরে তারা পরিস্থিতি ঘোলা করার অপচেষ্টা করছেন। তারা জানেন পুলিশ ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে এই সরকারের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব না।

ছাত্র-জনতা খুনের জন্য আওয়ামী পন্থী পুলিশের কর্মকর্তাদের দায়ী করে এক সাব-ইন্সপেক্টর বলছেন, ‘তারা আমাদের গুলি করতে বাধ্য করেছেন। রাবার বুলেটের পরিবর্থি লিথ্যাল (প্রাণঘাতি) অস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহারের কারনে অনেক ছাত্র-জনতা মারা গেছেন। অসংখ্য ছাত্র-জনতা পুঙ্গোত্ত্ব বরণ করেছেন। আবার কেউ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। এখন ছাত্র জনতা হত্যার বিচার করতে হলে সবার আগে ফাঁসবেন আওয়ামী দুঃশাসনের উচ্চবিলাসী ও ক্ষমতাধর পুলিশ কর্মকর্তারা । তাই নিজেদের দায়মুক্তি আদায়ের জন্য তারা পুরো ফোর্সকে উস্কানি দিচ্ছেন।

 সর্বশেষ ৯ ও ১০ আগস্ট কনস্টেবল সোয়াইবুরের নামে যে নির্দেশনাটি পুলিশ সদস্যদের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হয়েছে তা শেয়ার করেন এক পুলিশ সদস্য। সেখানে বলা হয়েছে, কর্মবিরতি চলছে, চলবে; কেউ গায়ে ইউনিফর্ম লাগাবেন না; নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে লাইনে সিভিল পোষাকে ডিউটি চলবে; লাইনের বাইরে কেউ ডিউটিতে যাবে না;  যে যেখানে আছেন, সে সেখানে অবস্থান করবেন; ঢাকার মধ্যে যারা আছেন, তারা রাজারবাগে উপস্থিত হবেন; ১১ দফা দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত পুলিশের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে; ভয়, হুমকি, গড় হাজির একযোগে প্রতিহত করবেন।

ভুক্তভোগী পেশাদার পুলিশ সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদেরকে বেনজির-হারুনরা যা আদেশ করতেন তা মানতে বাধ্য করা হতো। নইলে তাদেরকে নানা ভয়ভীতি, হয়রানি এবং সাজা প্রদান করা হতো। পুলিশ সদস্যরা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিষ্ঠুর আচরণ এবং নির্মমতার কথা মিডিয়ার কাছে ইতোমধ্যে ফাঁস করে দিয়েছেন। তাদের কু-কীর্তির কথা বলতে বলতে অনেক পুলিশ সদস্য হাউমাউ করে কান্নাও করেছেন। ভবিষ্যতে যাতে এই ধরনের নৃশংসতার সম্মুখীন হতে না হয় সে জন্য তারা পুলিশের নতুন আইজিপি ময়নুল হোসেনের পূর্ণ সহযোগিতা চেয়েছেন। একই সাথে দক্ষ ও মেধাবী  পুলিশ সদস্যদের কাজে লাগিয়ে পুলিশ বাহিনীকে জনগণের সেবক হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন। গত ৮  আগষ্ট গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছেও তাদের দাবি ভবিষ্যতে পুলিশ বাহিনী কোন রাজনৈতিক সরকার এবং ডিপার্টমেন্ট এর স্যারদের হুকুমের গোলাম হবেননা।

এদিকে নতুন আইজিপি ময়নুল হোসেন এবং ডিএমপি পুলিশ কমিশনার মাইনুল হাসানকে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা স্বাগত জানিয়েছেন। আইজিপির আহবানে সারা দিয়ে অনেক পুলিশ সদস্য স্ব-স্ব কর্মস্থলে  যোগদান শুরু করেছেন। পুলিশের আইজিপি বলেছেন, পুলিশ বাহিনীকে যারা ব্যবহার করে  নিজেদের স্বার্থের লিপ্ত ছিলেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে। পুলিশ বাহিনীর কোথায় ত্রুটি আছে তা গুরুত্ব দেয়া হবে।

এদিকে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় ছিনতাই, ডাকাতি, চুরি এবং লুটপাট ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। মানুষের জানমালের কোন নিরাপত্তা নেই। সাধারণ মানুষও পুলিশের উপর নির্ভর। সাধারন মানুষ উদ্বিগ্ন  এবং ভয়ভীতির মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। তাদের দাবি, দেশব্যাপী চারশ'র বেশি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি জালিয়ে দেয়া হয়েছে।   অসংখ্য পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। অনেক পুলিশ সদস্য আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। লুটেরা লুঠ করে নিয়েছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ। অধিকাংশ মামলার নথিপত্র পুড়ে ফেলা হয়েছে। বিশেষ করে গত ৫ আগষ্ট দুপুর তিন টার পর থেকে দেশের কোটি কোটি মানুষ শেখ হাসিনার পলায়নের খবর পেয়ে আনন্দ মিছিলে নামেন।  দুষ্কৃতকারীরা এই সুযোগে পুলিশের উপর চড়াও হয়ে ধাপে ধাপে হামলা চালায় থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি গুলোতে। অনেক পুলিশ সদস্য জীবন বাচাতে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়েন। আবার কেউ বা জীবন বাঁচাতে দুই হাত তুলে করজ্বরে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু পুলিশের উপর নানা আক্রোশ এবং স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এমন নেক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হয়। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ মনে করেন, পুলিশ বাহিনী হলো জনগণের আস্থার প্রতিক। পুলিশ জনগণের সেবক। মানুষের জান মালের হেফাজতকারী এই বাহিনীকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন অনৈতিক কাজ এই পুলিশ বাহিনী দিয়ে হাসিল করা হয়েছে। নিরাপরাধ, নির্দোষ, নির্ভেজাল লোকজনকে রাজনৈতিক মিথ্যা মামলা সহ নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। রাস্তায় তল্লাশির নামে আটকিয়ে অর্থ বাণিজ্য করেছে থানা পুলিশ। আবার অনেক সময় পুলিশ অনেকের পকেটে নেশাদ্রব্য ঢুকিয়ে দিয়ে মোটা টাকা নিয়ে ছেড়ে দিয়ে। আর দর কষাকসিতে না মিললে মামলা হাকিয়ে দেয়া হতো। রাস্তায় কাগজ পত্র চেকিং এর নামে গাড়ি থামিয়ে দেদারসে চাদাঁবাজির অভিযোগও রয়েছে। ফুটপাতের দোকানদাররাও রেহাই পাননি। রাজনৈতিক নেতাদের নিয়োজিত লাইনম্যানের মাধ্যমে  প্রকাশ্যে টাকা নিতেন পুলিশ। আবার সরকারি দলের নেতাদের খুশি রাখতে বিরোধী দল সহ বিভিন্ন দলের নেতাদের হয়রানি যেন নিত্যনৈতিক বিষয় হয়ে দাড়িয়ে ছিলো। অনেকটাই পুলিশ বাহিনীকে দেখলে মানুষ আস্থার জায়গায় অনাস্থায় পরিনত হয়ে ছিলো। রক্ষককে ভক্ষক মনে করতেন সাধারণ মানুষ। পুলিশের এসব করার পেছনে থানার ওসিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ  সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে। কারণ হিসেবে ভুক্তভোগী পুলিশ সদস্যদের বক্তব্য হচ্ছে, ওসিরা সব সময় বলতেন, এসি, এডিসি এবং ডিসি স্যারকে ম্যানেজ করা লাগবে। তাছাড়া উপরেও টাকা দিতে হয়। যে দারোগা বেশি বাণিজ্য করতে পারতেন সেই ছিলেন ওসিদের বেশি কাছাকাছি এবং আপনজন। রাজধানী সহ সারাদেশের থানা গুলোতে একই ধরনের চিত্র ছিলো।  উল্লেখ্য, বিভিন্ন সময়ে পুলিশের সংবাদ সম্মেলন বা পুলিশের নানা অপরাধ এবং অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে মিডিয়ার লোকজন আইজিপি, পুলিশ কমিশনার সহ উচ্চ পদস্থদের অবহিত করলে উল্টো ধাতানির শিকার হতেন। তাদেরকে কোন ক্রমেই বিশ্বাস তো দুরের কথা সময় মতো ফোন দিয়ে শাসিয়ে দেয়া হতো কিংবা ডেকে নিয়ে ইচ্ছেমতো গালমন্দ করে হুঁশিয়ারি দিয়ে ছেড়ে দেয়া হতো। আবার কাউকে নানা অযুহাতে মামলা দিয়ে জেলে প্রেরণ করার মতো ঘটনাও আছে। কিছু দালান সাংবাদিকও যোগসাজশ করে অসংখ্য সাংবাদিককে হয়রানি এবং মিথ্যা মামলায় সহযোগিতা করেছেন। এক পর্যায়ে অপরাধ বিষয়ক রিপোর্টাররা পুলিশের অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন বাদ দিয়ে শুধু সংবাদ সম্মেলন কভারেজ করতেন।

অভিজ্ঞ মহলের মতে, পুলিশের উচ্চ পদস্থদের এহেন আচরণের কারণে পুলিশ বাহিনীই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কারণ হিসেবে বলেন, এক সময় সাংবাদিকরা পুলিশের অনিয়ম দুর্নীতি পেলে লিখতেন। তাতে সুবিধা টা ছিলো যার বিরুদ্ধে লিখতেন তিনি শুধরিয়ে সঠিক ভাবে কাজ করতেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে গোটা পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা  সরকারের চাটুকারিতায় লিপ্ত হোন। রাজনীতিবিদদের মনযোগিয়ে কিভাবে প্রমোশন নিবেন তা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আর বড়ো বড়ো মামলা হাকিয়ে টাকা রোজগার ছিলো তাদের একমাত্র ধান্দা। কারো বিরুদ্ধে মামলা হাকাতে কিছু পুলিশ বাহিনী সুন্দরী নারীদেরকেও ব্যবহার করতেন। পরিমণিদের মতো সুন্দরী নারীরা প্রতি দিন ডিবি অফিস, সচিবালয় সহ বিভিন্ন থানায় রাতবিরাত যাতায়াত করতেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রাজধানীর থানা গুলো ছিলো ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ এবং কিশোরগঞ্জ বেল্টের দখলে। একই অবস্থা ছিলো বিভিন্ন বিভাগের মেট্রোপলিটন থানা ও জেলা সদর থানা গুলো। দক্ষ অফিসারদের তেমন কোন মূল্যায়ন ছিলো না বললেই চলে। অভিযোগ আছে, ঢাকার গুলশান, বনানী, তেজগাঁও, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, খিলক্ষেত, উত্তরা, মতিঝিল, পল্টন, কোতোয়ালি, শাহবাগ, নিউমার্কেট, সূত্রাপুর সহ বিভিন্ন থানায় বদলি হতে ওসিরা রাজনীতিবিদ এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পেছনে ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা খরচ করতেন। সাব ইন্সপেক্টরদের রেড ছিলো দশ লাখ থেকে বিশ লাখ টাকা। কনস্টেবল বদলি হতে  টাকা লাগতো দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা। আবার কেউ ক্ষমতা এবং টাকার জোরে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার ১৬ বছরে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় পোস্টিং নিয়ে চাকরি করছেন। তাদের একজন ওসি ফরমান আলী। তিনি গুলশান, বনানী, বিমানবন্দর, মতিঝিল, যাত্রীবাড়ি এবং উত্তরা পূর্ব থানায় ১৬ বছর ধরে আছেন। তিনি ওসিদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও প্রভাশালী ওসি হিসেবে পরিচিত। ফরমান আলী বনানী ও গুলশান থানায় থাকাকালীন সময়ে তার এক মক্ষীরানিকে দিয়ে ব্যবসায়ীদের ফাঁসিয়ে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফরমান আলীর ওই মক্ষীরানি গুলশান, বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় প্রশাসনের কিছু ব্যক্তির আশ্রয় প্রশ্রয়ে তিন লাখ টাকার বাসায় ভাড়া থাকেন। দুই নাম্বাতে রয়েছেন গুলশান থানার ওসি মাজহার। তিনিও কদমতলী, তেজগাঁও এবং গুলশান সহ বেশ কয়েকটি থানায় চাকরি করেছেন। দুই জনই পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের উপর পুলিশের অনেক সদস্য বিরক্ত থাকলেও ক্ষমতার কারণে কেউ মুখ খুলে কিছু প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ডিএমপির প্রত্যেক ওসি শত শত কোটি টাকার মালিক। তাদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন রাজনৈতিক নেতা এবং পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা।

সূত্রমতে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ছিলেন পুলিশ নির্ভর। গত ১৬ বছরে তিনি পুলিশের উপর ছরি ঘুরিয়েছেন এমন কোন নজির নেই। তিনি সব সময় টেকনিক্যাল সফটওয়্যার এর মতো যেদিকে ভারি বেশি সেদিকেই থাকতেন। উনার সময়কালে পুলিশের আইজিপি, পুলিশ কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ সুপার সহ সব বড়ো পদগুলোতে দায়িত্বে ছিলেন গোপালগঞ্জ সহ ফরিদপুর বেল্টের পুলিশ কর্মকর্তারা। পুলিশের কোনঠাসা অন্যসব  দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে এ নিয়ে ক্ষোভ ছিলো। যা এখন আস্তে আস্তে প্রকাশ করা শুরু হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় এসব পুলিশ অফিসাররা অনেকটাই সরকারের অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে মেনে নিতে অনাগ্রহ ছিলেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে। ওয়াকিবহাল সূত্রমতে, সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ পুলিশ বাহিনীতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে ছিলেন। ডিএমপির পুলিশ কমিশনার, র‌্যাবের ডিজি এবং আইজিপি থাকা অবস্থায় জমি দখল, ব্যবসায়ীদের শেল্টার ও পুলিশের কেনাকাটা সহ নানা ধরনের অপকর্ম করে হাজার কোটি টাকার মালিক  হয়েছেন। অপকর্ম ঢাকতে অবসরের পর একটি টেলিভিশনের ডিরেক্টরও হয়ে ছিলেন।  বর্তমানে দুদকের মামলায় বিদেশ পলাতক আছেন বেনজির আহমেদ।

ভুক্তভোগী এক ওসি জানান, পুলিশ বাহিনীর কাছে সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ আইজিপি হচ্ছে বেনজির। সাবেক সব আইজিপির মান ক্ষুন্ন করেছেন সাবেক এই আইজিপি। তিনি পুলিশের ভেতরে বিভাজন সৃষ্টি করে দুইটি গ্রুপে পরিণত করার মুল হোতা ছিলেন। সবই ছিলো তার ক্ষমতার লোভ এবং টাকা বানানোর উদ্দেশ্য। তাতে বেনজির সফলও হয়ে ছিলেন। অভিযোগ উঠেছে, বেনজিরের এসব অপকর্মের পেছনে মদদদাতা হিসেব ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। পুলিশ কমিশনার, র‌্যাবের ডিজি এবং আইজিপি থাকাকালীন সময়ে পুলিশ সদস্যদের হক মেরে নিজে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তিনি অবৈধ সম্পদ এবং হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েও নিজেকে সৎ ও নিষ্ঠাবান পরিচয় দিতেন। ধরা পড়ার পর ফেইসবুকে কয়েকদিন দাম্ভিকতার সাথে  ছবি ও সুন্দর লেখা পোস্ট করেন এক সময়ের ক্ষমতাধর এই আইজিপি। এরপর হঠাৎ স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে নিয়ে দেশ থেকে বিদেশ পালিয়ে যান।

সূত্রমতে, পুলিশের জুতা কেনাকাটায় সাগর চুরি করেছেন সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ। তেজগাও তেজকুনিপায় অবস্থিত মদিনা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েল ফুটওয়্যার, টেকস্কোয়াড, বেলাল  এন্ড ব্রাদার্স ও কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল ছিলো বেনজির আহমেদ এর চয়েস। ২৫ % কমিশনের মাধ্যমে তাদেরকে কাজ দিতেন বেনজির আহমেদ। রয়েল ফুটওয়্যার টেকস্কোয়াড এর মালিক জাকির হোসেন পাটোয়ারী, বেলাল এন্ড ব্রাদার্স এর মালিক বিল্লাল ও কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল কামরুল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর খুব আস্থভাজন ছিলেন। তাই তারাই নিয়মিত  জুতা কেনাকাটার টেন্ডারে সিডিউল কিনতেন এবং কাজ পেতেন।

এই জাকির হোসেন জনস্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউট এ ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার মেশিন সরবরাহ করেছে ১৫ কোটি টাকায়।কাগজে কলমে নারায়নগঞ্জ ডকইয়ার্ডকে দেখাইলে ও কাগজে কলমে বাস্তবে ছিলো ভিন্ন। কোটি কোটি টাকা আত্নসাতের এই নায়ক মুলত: বেনজির আহম্মেদ এর আস্থাভাজন থাকার কারনেই তা সম্ভব হয়েছে। তার বিস্তারিত আমলনামা ও দুর্নীতি তুলে ধরা হবে। যুবলীগ নেতার নামধারী এই ব্যাবসায়ী কিভাবে শত শত টাকার মালিক।

সূত্রমতে, কারওয়ানবাজারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের টাকার মেশিন ছিলেন লোকমান নামে এক ব্যবসায়ী। এই লোকমান টোকাই থেকে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের সার্বিক সহযোগিতায়। পিচ্চি হান্নান এবং শাহাবুদ্দিন র‌্যাবের ক্রস ফায়ারে মারা যাবার পর বেনজির ও আসাদুজ্জামান কামালের হাত ধরেই লোকমানের উত্থান বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা লোকমান পৌঁছে দিতেন বেনজির-কামালের কাছে। পূরো কাওরান বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন লোকমান।  আরেকজন ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিক। তিনি সব সময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতেন। সব কাজ ভাগাতেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে। যা ছিলো ওপেন সিক্রেট। গুলশান, বনানী সহ সব অভিজাত এলাকার হোটেল গুলো ছিলো আতিকের নিয়ন্ত্রণে। সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারি সহ ধরনের কাজ করতেন আতিকের নিজস্ব ঠিকাদার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে আতিকের ছিলো দহরম মহরম সম্পর্ক। এজন্য পুলিশ সপ্তাহকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রীকে খুশি রাখতে স্বরাষ্টমন্ত্রীর একজন এপিএস এর মাধ্যমে শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন মেয়র আতিক। যা প্রশাসনিক ভাবে তদন্ত করলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে বলে দাবি করেছেন উত্তর সিটি করপোরেশনের সাধারণ কর্মচারীরা।

এবার পুলিশ বিভাগে একতছত্র কায়েম এবং আধিপত্য বিস্তারকারী হারুনের ক্ষমতা ও উচ্চবিলাসিতার খবরে জানা যায়, বিএনপির জয়নাল আবেদীন ফারুককে সংসদ ভবনের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে সরকারের কাছে আস্থা অর্জন করেন হারুন ও বিপ্লব কুমার সরকার। দু'জনকেই পুরুস্কার হিসেবে প্রমোশন দেয়া হয়। বিপ্লব কুমার সরকারকে তেজগাঁও জোনের ডিসি এবং হারুকে নারায়নগঞ্জের এসপি হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। হারুন নারায়ণগঞ্জ থাকাকালীন সময়ে জমি দখল সহ সব ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েন। সেভেন মাডার সহ অনেক বড়ো বড়ো ঘটনার আসামীদেরকে হারুন দাপিয়ে বেড়ান। তার হুমকি ধামকিতে ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন। বিভিন্ন ঘটনায় আলোচনা সমালোচনার মুখে হারুনকে  পুলিশ হেডকোয়ার্টারে বদলি  করা হয়। ডিআইজি হারুন পুলিশ প্রশাসনে সাবেক রাষ্ট্রপতির নাম ভাঙ্গিয়ে অনেক কর্মকর্তাকেই বাঘে মহিষে পানি খাওয়াতেন বলেও গুঞ্জন আছে। ডিবিতে জয়েন্ট করার পর কাউকেই তিনি পরোয়া করতেননা। তার হাতে কতো মায়ের বুক খালি হয়েছে তা শুধু তিনিই ভালো জানেন। বির্তকিত এই পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে আলোচনা  সমালোচনার শেষ নেই। এর মতো সকল পুলিশ কর্মকর্তার অবসান হোক এটা পুলিশ বাহিনীর সময়ের দাবি। পুলিশের আইজিপির মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ভুক্তভোগী পুলিশ সদস্যদের দাবি, অভিযুক্ত প্রত্যেক পুলিশ কর্মকর্তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হোক। তাহলে পুলিশ বিভাগে নিয়ম শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। একই সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাসও পাবে ভুক্তভোগী পুলিশ সদস্যরা।

এদিকে সেনাবাহিনী ও বিজিবির সহায়তায় সারাদেশে প্রায় চারশ' থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ডিএমপির সবগুলো থানায় স্বাভাবিক কার্যক্রম ফিরে আসতে আরো কতদিন সময় লাগবে তা স্পষ্ট নয়। তবে ডিএমপির প্রতিটি থানায়  সেনাবাহিনীর সহায়তায় থানা পুলিশ কার্যক্রম সীমিত আকারে শুরু হয়েছে। এছাড়া সীমান্ত এলাকায় বিজিবির সহায়তায় কার্যক্রম শুরু হয়েছে। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার পতনের পর সারাদেশের থানার কার্যক্রম অচল হয়ে পড়ে।

সূত্রমতে, খুব শিগগির  পুলিশ বাহিনীতে চুরুনী অভিযান চালিয়ে আওয়ামী দুঃশাসনের সাথে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি দক্ষতার ভিত্তিতে পুলিশে বেশ কিছু লোকবল নিয়োগ দেয়া হবে। বিগত ১৬ বছরে ছাত্রলীগ নামধারী অনেক ক্যাডার পুলিশ বাহিনীতে চাকরি পেয়েছেন। তাদের নামের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি চাকরি পেয়েছেন গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর বেল্টের লোকজন। এদের পৃষ্ঠপোষকরাও ছাড় পাবেনা  বলে জানা গেছে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা