September 20, 2024, 12:49 pm


সালাহউদ্দিন মিঠু

Published:
2024-08-12 12:14:51 BdST

বিশ্বে আলোচনার শীর্ষে ড. ইউনুস


বিশ্বে অলোচনায় শীর্ষে থাকা একজন নোবেলজয়ী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তিনি বাঙ্গালী জাতীর গর্ব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস । এই নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুস কে নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে। বাংলাদেশে তিনি সফল একজন ব্যক্তিত্বশীল মানুষ। ড. মুহাম্মদ ইউনুসের প্রতিটি অর্জন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন । ক্ষুদ্রঋণের প্রথম প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক। ক্ষুদ্র থেকে শুরু করে দারিদ্র্য জয়ে হয়ে উঠেছে সুবিশাল।


দেশের দারিদ্র্যবিমোচনে তার ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু একটি গোষ্ঠি ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে আসছে বহু আগ থেকেই। একজন নারী গার্মেন্টসে কাজ করলে তার জীবনে পরিবর্তন ঘটে। আবার ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যে নারী ছোটখাটো ব্যবসা করছেন, তার জীবনেও পরিবর্তন আসে স্বাধীন হয়ে। যদিও ক্ষুদ্রঋণের সুদহার ও তা আদায় নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকলেও শুধুমাত্র না জানার কারনে তা নিয়ে প্রায়শ:ই বিতর্ক হয়েছে। তারপরও এটা অনস্বীকার্য যে, গ্রামীণ ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের কারণেই বাংলাদেশে মহাজনী প্রথার এক ধরনের বিলোপ ঘটেছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কেবল ঋণ পাওয়ার উৎসই নয়, বরং অর্থ সঞ্চয়, বীমা ও অর্থ স্থানান্তরের সুযোগও করে দিয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার প্রবর্তক হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক একে অপরের পরিপূরক। ১৯৭৬ সাল হতে এ দেশের সুদক্ষ গোষ্ঠি এই বিষয়টা নিয়ে জানতে পারেন এবং সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে দেশের প্রায় এক কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের গ্রামীণ ব্যাংক। দারিদ্রদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ। ঋণ সহায়তার মাধ্যমে দরিদ্রদের জীবনমান উন্নয়নে অবদান রাখায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংককে ২০০৬ সালে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা ও এর বিকাশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অবদান অনস্বীকার্য। প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার দায়িত্বে থেকে নিজের ব্যক্তিগত অর্থ দিয়ে দরিদ্রদের ঋণ-সহায়তার মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করেন তিনি। পরে সরকারের অধ্যাদেশ বলে ১৯৮৩ সালের ২ অক্টোবর এটি স্বাধীন ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর ২০১১ সালের ১০ মে পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদে দায়িত্ব পালন করেন ড. ইউনূস। সরকারের সঙ্গে টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালের ১১ মে এমডি পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। মূলত: এরপর থেকেই প্রশ্ন ওঠে ড. ইউনূসকে ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক টিকে থাকতে পারবে কি না?


পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মুহাম্মদ ইউনূস-পরবর্তী সময়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতৃত্বে কিছুটা অচলাবস্থা দেখা দিলেও গ্রামীণ ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে কোনো ব্যাঘাত হয়নি। বরং ২০১১ সালের পর থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ ও সদস্যদের জীবনমান উন্নয়নে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের আরও ব্যাপ্তি ঘটেছে। তবে তা ইউনূস দায়িত্বে থাকার সময় উচ্চহারের যে প্রবৃদ্ধি ছিল, তার তুলনায় কম। অবশ্য মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করার পরবর্তী বছরগুলোতে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণের পরিমাণ ও মুনাফা শতাংশের হিসাবে কমলেও টাকার অঙ্কে ব্যাপক বেড়েছে। একই সময় আবাসন ও শিক্ষাঋণের পরিমাণও বেড়েছে। মূলত: কার্যক্রমে ড. ইউনূস প্রবর্তিত মডেল বহাল থাকায় গ্রামীণ ব্যাংকের সফলতা আরও বেড়েছে তার অনুপস্থিতিতেও।
২০১১ সালের ১১ মে ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ জন্য গ্রামীণ ব্যাংকে ইউনূস-পরবর্তী সময়কালের কার্যক্রম মূল্যায়নে ২০১০ সালের আর্থিক প্রতিবেদন বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ড. ইউনূস ব্যাংকটি ছেড়ে যাওয়ার আগের বছরে ব্যাংকটির সদস্য সংখ্যা ছিল ৮৩ লাখ ৪০ হাজার, যা ২০০২ সালের তুলনায় ২৩৫ শতাংশ বেশি। আর ২০১৮ সাল শেষে (ব্যাংকটির সর্বশেষ প্রকাশিত নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন) এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৯০ লাখ ৮৪ হাজারে। অর্থাৎ ইউনুস-পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ।
২০১০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের মোট ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। ইউনূসের সর্বশেষ আট বছরে ঋণ বিতরণের পরিমাণ বেড়েছিল ৫১০ শতাংশ। আর ইউনূস-পরবর্তী সময়ে ঋণ বিতরণের পরিমাণ বেড়েছে ১৫৬ শতাংশ। ২০১৮ সালে ব্যাংকটি ২৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে। ড. ইউনূস-পরবর্তী আট বছরে গ্রামীণ ব্যাংকের নতুন শাখা খোলায় তেমন অগ্রগতি হয়নি। তবে নিট মুনাফায় বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। ২০১৮ সাল শেষে গ্রামীণ ব্যাংকের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকা, যা ২০১০ সালে ছিল ১২ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকা।


ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের মাধ্যমে দারিদ্র্যদূরীকরণ মূল লক্ষ্য হলেও এর মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য মুনাফাও করছে গ্রামীণ ব্যাংক। মুহাম্মদ ইউনূসের সময় গ্রামীণ ব্যাংক সবচেয়ে বেশি মুনাফা করে ২০০৬ সালে, ১৩৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা। বড় অঙ্কের সঞ্চিতির কারণে ২০১০ সালে নিট মুনাফা কিছুটা কমে যায়। এ সময় নিট মুনাফা হয় ৭৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ২০১৮ সাল ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মুনাফার বছর। এ সময় ব্যাংকটির নিট মুনাফা হয় ৩৪৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা, যা থেকে শেয়ারহোল্ডারদের ৩০ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ দেওয়া হয়।
পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, দরিদ্রদের জামানতবিহীন ঋণ বিতরণের পরও গ্রামীণ ব্যাংক অধিকাংশ সময়ই নিট মুনাফায় থেকেছে। মূলত ঋণ আদায় পদ্ধতির কারণে দেশের অন্যান্য ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের তুলনায় গ্রামীণ ব্যাংকের মন্দঋণের পরিমাণ সর্বনিম্ন। ২০১৮ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের মাত্র শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ ছিল মন্দমানের। যেখানে ব্র্যাকের ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ, আশার ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ, টিএমএসএসের ৩ দশমিক ১৩ শতাংশ ও ব্যুরো বাংলাদেশের বিতরণ করা ঋণের ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশই ছিল মন্দমানের বা খেলাপি। ঋণের টাকা ফেরত নিশ্চিত করতে গ্রামীণ ব্যাংক ‘সংহতি দল’ পদ্ধতি ব্যবহার করে। একটি অনানুষ্ঠানিক ছোট দল একত্রে ঋণের জন্য আবেদন করে এবং এর সদস্যরা একে অন্যের জামিনদার হিসেবে থাকে। ব্যাংকের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সদস্যদের আয়ে বহুমুখিতা আনতে অন্যান্য পদ্ধতিও প্রয়োগ করে।


২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ৩ কোটি ৫ লাখ লোককে ঋণ দেয়। শীর্ষ পাঁচটি ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান দেয় ৯৬ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকেরই ছিল ২৫ শতাংশ। গ্রামীণ ব্যাংকের রয়েছে ২ হাজার ৫৬৮টি শাখা, যেগুলোর মাধ্যমে ৮১ হাজার ৬৭৭টি গ্রামে ক্ষুদ্রঋণ, স্কলারশিপ, শিক্ষাঋণসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা দেওয়া হচ্ছে। গ্রামীণ ব্যাংকের মোট সদস্যের প্রায় ৯৭ শতাংশই মহিলা। ২০১৮ সালে ব্যাংকটি ২৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ব্যাংকটি মোট ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করল। ২০১৮ সালে ব্যাংকটিতে সদস্যদের আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। আর ব্যাংকটির সদস্য নন এমন গ্রাহকদের আমানত দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা। এ সময়ে ব্যাংকটিতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় ২২ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা, যা ২০১০ সালে ছিল ১০ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা।


গ্রামীণ ব্যাংক সাধারণত বেসিক লোন, মাইক্রো এন্টারপ্রাইজ লোন, হাউজিং লোন ও উচ্চশিক্ষায় লোন দেয়। এর বাইরে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিতদেরও সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে থাকে। আয়বর্ধনকারী কাজের জন্য বেসিক ঋণ দেওয়া হয়, যার সুদের হার সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ। গ্রামীণ ব্যাংকের মোট ঋণের বেশির ভাগই এই স্কিমের আওতায়। আর গৃহঋণে সুদের হার ৮ শতাংশ। উচ্চশিক্ষা ঋণের ক্ষেত্রে অধ্যয়নকালীন ঋণ সুদমুক্ত; শিক্ষা শেষে সুদহার ৫ শতাংশ। গ্রামীণ ব্যাংকের সব ঋণই বীমা সুবিধার অন্তর্ভুক্ত।


স্কলারশিপ প্রোগ্রামের আওতায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৩ লাখ ৩২ হাজার ৫২৮ জন শিক্ষার্থী গ্রামীণ ব্যাংকের সুবিধা পেয়েছে। এ ছাড়া মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিসহ বিভিন্ন উচ্চশিক্ষায় ৫৪ হাজার ১৪৩ শিক্ষার্থীকে শিক্ষাঋণের সুবিধা দিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক। ২০১০ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪৭ হাজার ৮৫১ জন। ১৯৮৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক তার ৭ লাখ ৩৫ হাজার সদস্যদের আবাসন সুবিধার জন্য ঋণ দিয়েছে।


গ্রামীণ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিতরণ করা ঋণ থেকে ২০১৮ সালে ব্যাংকটির সুদবাবদ আয় হয় ৩ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। আমানত ও ধারের বিপরীতে ব্যাংকটি পরিশোধ করে ১ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। এতে ২০১৮ সালে সুদবাবদ নিট আয় হয় ২ হাজার ২ কোটি টাকা। বিনিয়োগের লভ্যাংশ, অন্যান্য আয়সহ ২০১৮ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয় ২ হাজার ২২৯ কোটি টাকা।


গ্রামীণ ব্যাংকের আয়ের বড় অংশই ব্যয় হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ। ২০১৮ সালে এ খাতে ব্যয় হয় ১ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। এ সময় কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছিল ১৮ হাজার ৩৫৩ জন। সব মিলিয়ে ২০১৮ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় ছিল ১ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ব্যাংকটিকে মন্দঋণের বিপরীতে ৩৫৯ কোটি টাকা সঞ্চিতি হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। গ্রামীণ ব্যাংককে তার মুনাফার ওপর কোনো কর দিতে হয় না। ফলে সঞ্চিতি সংরক্ষণের পর ২০১৮ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের নিট মুনাফা হয় ৩৪৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
২০১০ সালের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ সময় গ্রামীণ ব্যাংকের সুদবাবদ আয় ছিল ১ হাজার ২৪৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয় ৯২২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ফলে নিট সুদ আয় হয় ৩২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ২০১০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের আয়ের বড় অংশ আসে বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা স্থায়ী আমানত থেকে। তখন ব্যাংকটির মোট আমানত ছিল ১০ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা, যার প্রায় অর্ধেক ৪ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা স্থায়ী আমানত হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা ছিল। এর বাইরে গ্রামীণ মিউচুয়াল ফান্ড ওয়ানে ২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকার বিনিয়োগ ছিল। এ সময় বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা স্থায়ী আমানত থেকে সুদ বাবদ আয় হয় ৩৯৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এতে ২০১০ সালে ব্যাংকটির পরিচালন আয় দাঁড়ায় ৮৫১ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এ সময় ব্যাংকটির ২২ হাজার ২২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় হয় ৪৬৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে পরিচালন ব্যয় দাঁড়ায় ৬৮০ কোটি টাকায়। ফলে সঞ্চিতি-পূর্বক ব্যাংকটির মুনাফা দাঁড়ায় ১৭০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। ওই বছরে ব্যাংকটিকে মন্দঋণের বিপরীতে মোট ৯৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা সঞ্চিতি হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। ফলে ব্যাংকটির নিট মুনাফা দাঁড়ায় ৭৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা।


ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২৮ জুন, ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার বাথুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উনার পিতার নাম হাজী দুলা মিয়া সওদাগর যিনি পেশায় একজন জহুরি ছিলেন এবং মাতার নাম সুফিয়া খাতুন। দুই ভাই ও নয় বোনের মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন তৃতীয়। মুহাম্মদ ইউনূসের ভাই মুহাম্মদ ইব্রাহিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং ছোট ভাই মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর একজন জনপ্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব। মুহাম্মদ ইউনূসের সহধর্মিনীর নাম ড. আফরোজী ইউনুস। দুই কন্যার জনক মুহাম্মদ ইউনূস এর এক মেয়ের নাম মনিকা ইউনূস এবং অন্য জনের নাম দীনা আফরোজ ইউনূস।


শিক্ষা জীবনের শুরুতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার গ্রামের মহাজন ফকিরের স্কুল নামে একটি বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালে তার পরিবার চট্টগ্রাম শহরে চলে আসায় তিনি গ্রামের স্কুল থেকে লামাবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।


মাধ্যমিক পর্যায়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ৩৯ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৬ তম স্থান অধিকার করেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি বয়েজ স্কাউটসে যোগদান করেন এবং বয়েজ স্কাউটসের পক্ষ থেকে মাত্র ১৫ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ এশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।
পরবর্তীতে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। এই সময়ে তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন এবং কলেজ জীবনেই নাটকে অভিনয় করার জন্য প্রথম পুরষ্কার অর্জন করেন। এছাড়াও কলেজে অধ্যয়নকালীন সময়েই ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা এবং আজাদী পত্রিকায় কলাম লেখার কাজে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই বিএ এবং এমএ সম্পন্ন করেন।


স্নাতকের পর কর্মজীবনের শুরুতেই মুহাম্মদ ইউনূস ব্যুরো অব ইকোনমিক্স -এ গবেষণা সহকারী হিসাবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজের অর্থনীতির প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন।


১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এই পদে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৬ সালে মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। অর্থনৈতিক ভাবে দরিদ্র বাংলাদেশী নাগরিকদের ব্যাংকিং সুবিধায় আনার আনার জন্য এবং ঋণ প্রদান করার জন্য এই ব্যাংকটির অবদান রয়েছে অনেক। দরিদ্র নাগরিকদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এই ব্যাংকিং মডেলটি বিশ্বদরবারে অনেক প্রশংসা অর্জন করে এবং বিশ্বের অনেক উন্নত ও শিল্পোন্নত দেশসমূহ গ্রামীণে ব্যাংকের এই মডেল ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ হয়। তার এই অবদানের জন্য মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে আগস্ট ২০২৪ তারিখে তিনি অর্ন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।


১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের পক্ষে বিদেশে জনমত গড়ে তোলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদানের জন্য সাংগঠনিক কাজে নিয়োজিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে মুহাম্মদ ইউনূস দেশের নাগরিকদের দারিদ্র্যতার বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত দুর্ভিক্ষের সময় তিনি বুঝতে পারেন স্বল্প পরিমাণে ঋণ দরিদ্র মানুষের জীবন মান উন্নয়নে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। সেই সময়ে তিনি গবেষণার লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক প্রকল্প চালু করেন। ১৯৭৪ সালে মুহাম্মদ ইউনুস তেভাগা খামার প্রতিষ্ঠা করেন যা সরকার প্যাকেজ প্রোগ্রামের আওতায় অধিগ্রহণ করে।


মুহাম্মদ ইউনূসের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ:
নিজের জ্ঞাণ ও ভাবনাগুলো সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে মুহাম্মদ ইউনূস নিজের লেখা বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশ করেন। যার মধ্যে অন্যতম বইগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হল:- দারিদ্র্য হীন বিশ্বের অভিমুখে, দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্বের জন্য, গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন, পথের বাধা সরিয়ে নিন, মানুষকে এগুতে দিন প্রভৃতি। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার ছাড়াও ড.মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬২টি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়াও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল অর্জন করেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১০ টি দেশ থেকে বিশেষ সম্মাননা সহ সর্বমোট ২৬ টি দেশ থেকে ১১২ টি পুরষ্কার লাভ করেন।
উল্লেখ্য ব্যাক্তিগত জীবনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস কোন দলীয় রাজনীতি করেন নি। তবে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার মাত্র ৫ মাসের মধ্যে তিনি নাগরিক শক্তি নামক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করতে চেয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে এই প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেন। তবে ২০০৭ সালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে প্রস্তাব পেয়েছিলেন ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস। সেবার তিনি এই প্রস্তাবটি নাকচ করে দেন।

 

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা