September 20, 2024, 11:35 am


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2024-08-14 18:44:09 BdST

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগদৈনিক হাজিরার কর্মচারী থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক লোকমান


দৈনিক হাজিরার কর্মচারী থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া লোকমান হোসেন খানের নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ জমা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। তার অবৈধ সম্পদের বিষয়ে প্রাক অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদকের গোয়েন্দা শাখা। শিগগিরই তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ হওয়ার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

একাধিক সুত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক স্কুলের গন্ডি পার না হওয়া এই হাজী লোকমান এক সময় পুরান ঢাকার হাজী সেলিম এমপির ব্যাটারি তৈরির কারখানা আল-মদিনা ব্যাটারি ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন দৈনিক দেড় টাকা বেতনে। পরে মাসে বেতন পেতেন ১৫০ টাকা। একসময় তিনি ব্যাটারি কারখানায় কয়লা সরবরাহ শুরু করেন।

পরে হাজী সেলিম তার কিছু অর্থ বেনামে গচ্ছিত রাখেন লোকমানের কাছে। লোকমান ওই সময় হাজী সেলিমের অর্থপাচারসহ নানান কাজে দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে যাতায়াত শুরু করেন। সেখানে গিয়ে মানব পাচারে যুক্ত হন। এর মাধ্যমে প্রতিমাসে আয় করেন লাখ লাখ টাকা। জড়িয়ে পড়েন স্বর্ণ চোরাচালন ও হন্ডির কারবারে।

দুবাইতে তার বিশ্বস্থ সহযোগী চট্টগ্রামের দিদার হোসেন ও হাসানের মাধ্যমে দিরহাম সংগ্রহ করেন। ওই দিরহাম দিয়ে স্বর্ণের বার কিনে দেশে আনেন। চট্টগ্রামের দিদার ও ঢাকার হাসান যেসব হুন্ডির দিরহাম সংগ্রহ করেন সেগুলোর টাকা বাংলাদেশে দিয়ে দেন লোকমান ও তার ম্যানেজার হেলাল। এভাবে নানা অনৈতিক কারবারে জড়িয়ে অল্পদিনে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যান লোকমান। বাগিয়ে নেন রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘সিআইপি’ পদ।

লোকমান প্রতি সপ্তাহে বাংলাদেশ থেকে বড় অংকের ডলার দুবাই নিয়ে যান এবং দুবাই থেকে বিপুল পরিমানা ঋণ বাংলাদেশে আনেন। বিমানবন্দরে কয়েক দফায় তার ক্যারিয়ার ধরা পড়লেও গডফাদার লোকমান থেকে যান ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

হুন্ডি ও মানবপাচারের পাশাপাশি দেশে সিসা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত ব্যাটারি কারখানাসহ বিভিন্ন ব্যবসা শুরু করেন লোকমান হোসেন। তার ভাতিজির নামে প্রতিষ্ঠা করেন পান্না গ্রুপ। পান্না ব্যাটারির উৎপাদক ও ভলবো ব্যাটারির আমদানীকারক তার কোম্পানী। এর মাধ্যমে নিজেকে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক দাবি করেন।

এগুলো তার কথিত সফলতার গল্প। কিন্তু তার সফলতা ছাপিয়ে উত্থানের নেপথ্যে রয়েছে বড় ধরনের চোরাচালান ও জালিয়াতির ইতিহাস। তিনি মূলত একজন হুন্ডি ব্যবসায়ী, বৈদেশিক মুদ্রা, স্বর্ণ, মাদক ও মানব পাচারকারি। এই পাচারে নিজেকে জড়িত করে শনৈ শনৈ উন্নতি হয়েছে তারা। হয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক।

তিনি মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাতে রাজধানী দুবাইতে ব্যাটারি পাঠানোর আড়ালে অর্থ, মাদক দ্রব্য ও মানবপাচার করেন। করেন ওভার ইনভয়েসিং। সেখানে রয়েছে তার বিশাল সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটের মূল নিয়ন্ত্রক চট্টগ্রামের দিদার।

লোকমানের পান্না গ্রুপের অফিস স্টাফরা জানান, তিনি ‘ব্যবসায়িক কাজে বিদেশে অবস্থান করছেন। অথচ বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে তিনি র্বতমানে দুবাই অবস্থান করছেন।’

দুবাইতে হাইপার ক্যাপিটাল ইন্টারন্যারশনাল ও রোজা ফিনান্স নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। সম্প্রতি তিনি আড়ই মিলিয়ন ডলারের একটি চালান বাংলাদেশ থেকে দুবাই নেওয়ার চেষ্টা করছেন। দুবাই জনতা ব্যাংক, এইচএসবিসি ব্যাংক মিডিল ইস্ট লিমিটেড, ব্যংক অব বোরদা ইন্ডিয়া, আবর ব্যাংক পিএলসি, ন্যাশনাল ব্যাংক ও এডিসিবি ব্যাংকে তার একাউন্ট রয়েছে। রোজা ফাইনান্স গ্রুপের মাধ্যমে তিনি বিপুল অংকের টাকা পাচার করেছেন। তিনটি ব্যাংকে তিনি দৈনিক ৩-৪ কোটি টাকা লেদদেন করেন। এছাড়া দুবাই ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, কমার্সিয়াল ব্যাংক অব দুবাই, সারজাহ ইসলামী ব্যাংক পিজেএসসি, সাম্বা ফাইনান্স গ্রুপ-এর মাধ্যমে ওভার ইনভয়েসিংসহ নানা কৌশলে তিনি অর্থ পাচার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

লোকমান হোসেন নানান কোম্পানীর আড়ালে দুবাইতে মানব পাচার, মুদ্রা পাচার ও সোনা চোরাচালানের কারবার করেন। বহুল আলোচিত ওয়ান ইলেভেনের পর ও পরর্বতীতে হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধানে নামলে দুবাই গিয়ে আত্মগোপন করেন লোকমান। তিনি প্রতিমাসে দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর যান। প্রতিবার যাওয়ার সময় তিনি মানবপাচার করেন। আসার সময় নিয়ে আসেন স্বর্ণের বার ও যাওয়ার সময় নিয়ে যান বৈদেশিক মুদ্রা।

অবৈধ পথে সম্পদের পাহাড়:

চোরাকারবার ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঢাকার লালবাগের নবাবগঞ্জ বাজার লেনে কমপক্ষে ৬টি বাড়ির মালিক এই হাজী লোকমান। ঢাকার লালমাটিয়ার ডি- ব্লকের ৩/১২ নম্বর বাড়ি (কেয়ারটেকার রিপন), হাজারীবাগে পান্না টাওয়ার, ঠিকানা: হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ (হাজারীবাগ ফায়ার স্টেশনের উল্টো পাশে) তার বিশাল ভবন রয়েছে। সদরঘাটে ও মতিঝিলেও রয়েছে ভবন।

তার বেশ কয়েকটি ভবন খাস জমি ও সাধারণ মানুষের জমি দখল করে করা। কিন্তু হাজী সেলিমের বিশ্বস্থ ক্যাডার হওয়ায় কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পায় না। লোকমানের ধানমন্ডি ও গুলশানে আছে অভিজাত ফ্ল্যাট। যেটি তার ঢাকাই ‘হেরেমখানা’ হিসেবে পরিচিত। সেখানে দেশি-বিদেশি লোকজন নিয়ে আড্ডা দেন তিনি। এছাড়া বসুন্ধরায় রয়েছে ফ্ল্যাট ও প্লট।

এছাড়া পান্না ডিস্ট্রিবিউশন, আলতু খান জুট মিল, পান্না ব্যাটারি লিমিটেড, লুবেন লিমিটেড, পিআরডিএফসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে তার। পান্না ডিস্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে ভলবো, পিবিএল অ্যান্ড ম্যাক্স পাওয়ার, ইত্যাদি ব্যাটারি আমদানী ও বাজারজাত করেন। তার ভাইয়ের নামে মধুখালিতে ৫ শত বিঘা জমি কিনেছেন। তার দুই স্ত্রী, দুই মেয়ে এক ছেলে এবং দুই ভাইয়ের নামে অপ্রদর্শিত বিপুল সম্পদ রয়েছে।

ফরিদপুরের মধুখালীতে তার আলতু জুট মিলের অফিস। সেখানে যখনই যান হেলিকপ্টার নিয়ে যান। আলতু জুট মিলের নামে মুধখালীতে অসংখ্য কৃষকের জমি জোর করে দখলের অভিযোগ রয়েছে লোকমানের বিরুদ্ধে। সরেজমিন অনুসন্ধান করলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

লোকমান গংরা জমি দখল করার কারনে এলাকায় বহু আগেই স্থানীয়রা মানববন্ধন ও ঝাড়ুমিছিল করেছিল। হাজী লোকমান অনেক টাকা ব্যয় করে স্থানীয় প্রভাবশালীদের মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেন। এই জুট মিলের শ্রমিকদের ঠকানো ও তাদের প্রাপ্য পাওনা না দেওয়ার অভিযোগ বহু পুরনো।

দুবাইতে পান্না গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন, ৪৯ এফজে+কিউ৩এইচ, দুবাই সিলিকন ওয়েসিস ঠিকানায় রয়েছে তার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী। এই কোম্পানীর আড়ালে তিনি দুবাইতে মুদ্রা ও নারী পাচার করেন। তার পাসপোর্ট নীরিক্ষা করলেই ফ্রীকোয়েন্ট ট্রাভেলার হিসেবে তার নাম চলে আসবে। পাসপোর্ট নং বি-০০০২১১৬৭ (বাংলাদেশ)।

দুবাইতে তার বেশ কয়েকটি বাড়ী আছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি যতবারই দুবাই যান ততোবারই একজন সুন্দরী নারী সাথে করে নিয়ে যান। দুবাই ডনদের সাথেও তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।

লোকমান নিজের অপর্কম আড়াল করার উদ্দেশ্যে নিজের ছেলে মেয়ের নাম বাদ দিয়ে নিজের ভাইয়ের মেয়ে (ভাতিজি) পান্নার নামে পান্না গ্রুপ খোলেন। তার এই পান্না গ্রুপ কোটি কোটি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। যার মাধ্যমে দ্রতই তার কোম্পানী ফুলে ফেঁপে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। কয়েকদিন আগে তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ১৫ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। তখন হাজী লোকমান তুচ্ছ করে বলেন, এই ১৫ কোটি টাকা আমার হাতের ময়লা।

সেনাবাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তা কানেকশন

হাজী লোকমান তার অপরাধ সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য আওয়ামী লীগের দলীয় ফান্ডে প্রায় ২০ বছর যাবত অর্থ অনুদান বা চাঁদা দিয়ে আসছেন। যেহেতু তার বাড়ী ফরিদপুর জেলায় সেহেতু এই জেলার কমপক্ষে ৫ জন আওয়ামী দলীয় এমপিকে তিনি কেবল নির্বাচনী খরচ বাবদই শত কোটি টাকা চাঁদা দিয়েছেন। যা তার একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী সুত্রে জানা গেছে। তিনি আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ ডোনার হিসাবে সর্বমহলে পরিচিত। যে কারণে তাকে সিআইপি মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বিগত সময়ে তিনি আয়নাঘরের প্রধান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জিয়াউল হাসানের সাথে এবং র‌্যাবের সাবেক একজন মহাপরিচালক এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এ ছাড়াও ডিএমপির সাবেক পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি মনিরুজ্জামান, ডিআইজি বাতেন ও ডিবির ডিআইজি হারুনের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। তাদের মাধ্যমে বেশ কিছু বিএনপি, জামায়াত নেতা-কর্মীকে হত্যা ও গুম করিয়েছেন বলেও প্রচার আছে। এই দুই সেনা ও র‌্যাব কর্মকর্তার সাথে প্রায়ই তিনি মিলিত হতেন এবং জামায়াত- বিএনপিকে শেষ করার প্ল্যান করেন এমন অভিযোগ উঠেছে।

ধানমন্ডির বাড়ীতে অবৈধ চিড়িয়াখানা

অনুসন্ধানে জানা যায, তিনি বাংলাদেশে প্রচলিত বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন ভংগ করে তার ধানমন্ডির বাড়ীতে একটি মিনি চিড়িয়াখানা গড়ে তুলেছেন। সেখানে বেআইনীভাবে ২ টি বাঘ, ১১ টি হরিণ ও ৩ টি ময়ুর খাঁচাবন্দী করে রেখেছেন। এ বিষয়ে তিনি বন বিভাগ থেকে কোন প্রকার ছাড়পত্র বা অনুমোদন গ্রহন করেননি যা একটি দন্ডনীয় ফৌজদারী অপরাধ।

আওয়ামী লীগের একডজন মন্ত্রী, এমপি তার আশ্রয়ে

একাধিক সুত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের অধিকাংশ মন্ত্রী এমপি তার ঘনিষ্ঠজন। গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারত চলে যাওয়ার পর তিনি তার বাড়ীতে প্রায় এক ডজন আওয়ামী লীগ নেতা (মন্ত্রী, এমপি) কে আশ্রয় দিয়েছেন। কাউকে কাউকে বিদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এই বিষয়ে কথা বলার জন্য তার সেল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে তার ধানমন্ডির বাসভবনে যেয়ে খোঁজ করলেও বাসা থেকে জানানো হয় যে, তিনি এখন দুবাই আছেন।
দেশ প্রেমিক ছাত্র-জনতা অনতিবিলম্বে এই আওয়ামী ডোনার ও আওয়ামী সিআইপিকে গ্রেফতার করে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার জোর দাবী তুলেছেন।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা