September 24, 2024, 11:21 am


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2024-09-24 08:46:19 BdST

হোমল্যান্ড লাইফে ৬ বছরে গ্রাহকের ২০০ কোটি টাকা লোপাট


গ্রাহকের টাকা লুটপাটে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটিতে লুটপাটে জড়িত পরিচালকরা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কয়েকশ কোটি টাকা দুর্নীতি ধামাচাপা দিচ্ছেন। গত ৬ বছরে কোম্পানিটি থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে।

গত ১০ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাব খাটিয়ে পরিচালক কর্মকর্তাদের একটি গ্রুপ এই লুটপাট করেছে আরও ভয়াবহভাবে। সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি থাকার পরও গ্রাহকের টাকা উদ্ধারে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। উদ্ধার হয়নি কোনো টাকাও। অপরদিকে লুটপাটের এই ক্ষত নিয়েই চলছে হোমল্যান্ড লাইফ।

বোর্ড সভার কার্যবিবরনী জালিয়াতি, জমি ক্রয়ের ভুয়া কাগজ তৈরি, কমিশন ও অন্যান্য খাতে খরচের ভাউচার তৈরি করে এই টাকা আত্মাসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। দি ফিন্যান্স টুডের প্রাথমিক অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কোম্পানির তহবিল আত্মসাতের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ গ্রাহকরা। পলিসির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও টাকা পাচ্ছেন না বছরের পর বছর ধরে। পাওনা আদায়ে শাখাগুলোতে ধরণা দিচ্ছেন গ্রাহকরা। এমনকি টাকা আদায়ে ব্রাঞ্চগুলোতে গ্রাহকরা হামলা করছেন, মারধরের শিকার হচ্ছেন ব্রাঞ্চগুলোতে কর্মরত মাঠকর্মীরা। যার ফলে নিরাপত্তাজনিত কারনে ও গ্রাহকদের টাকা দিতে না পেরে অনেক কর্মী বাড়ি ছাড়া।

অথচ গ্রাহক হয়রানি বন্ধ, তাদের পাওনা টাকা পরিশোধ করা ও আত্মসাৎ হওয়া টাকা উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার। বীমা খাত নিয়ন্ত্রক সংস্থায় টাকা উদ্ধারের বিষয়ে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার হয়নি। এমন অবস্থায় পুরনো দাবি পরিশোধ না করায় নতুন ব্যবসা সংগ্রহও কমে গেছে।

এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তারা দি ফিন্যান্স টুডেকে বলেন, আবারও লুট করতে নানা আয়োজন করছে বর্তমান পর্ষদ ও নতুন নিয়োগ পাওয়া এমডি। একজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিকে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যার সব শিক্ষাগত সনদ জাল।

বর্তমানে হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সে প্রায় ৬০ কোটি টাকা ডিপোজিট আছে। সেগুলো লুট করার জন্য অপচেষ্টা করছে একটি গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীটি পুরো টাকা আত্মসাৎ করে কোম্পানি দেউলিয়া ঘোষণা করার ষড়যন্ত্র করছে।

যেভাবে আত্মসাৎ করা হয় গ্রাহকের টাকা

নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ) করা এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নানা ধরনের ভুয়া বিল ভাউচার দিয়ে কোম্পানির কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে।

আইডিআরএ তদন্তে বলা হয়েছে, রাজধানীর একটি আবাসিক এলাকায় থাকা হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের ১৫০ কাঠা জমি বিক্রি করা হয়। ২০১৯ থেকে ২০২১ সালে বিক্রি করা ওই জমির মূল্য ছিল ৭০ কোটি টাকা। গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধের জন্য জমি বিক্রি করা হয়। কিন্তু পুরো টাকা আত্মসাৎ করে বীমা দাবি পরিশোধ করা হয়নি। বীমা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে কোম্পানি স্থায়ী আমানত থেকে উত্তোলন করে। এমনকি জমি বিক্রি করার কোনো তথ্য সংগ্রহে না রেখে পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়।

বীমা দাবি পরিশোধের জন্য একদিকে জমি বিক্রি করা হয়েছে অন্যদিকে কোম্পানির স্থায়ী আমানত থেকে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট বছরের বীমা দাবি পরিশোধ করা হলেও পূর্বের কোনো দাবি পরিশোধ করা হয়নি। এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৮৮ কোটি টাকা পূর্বের (২০১৭ সালের আগে) বীমা দাবি পরিশোধের জন্য দেখানো হলেও কোনো টাকা পরিশোধ করা হয়নি।

২০২২ সালে আইডিআরএ'র করা নীরিক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয় মোট বীমা দাবি ছিল ৩ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকা। অথচ কোম্পানির নিজস্ব প্রতিবেদনে দেখানো হয় বীমা দাবি ৬৮ কোটি টাকা। এই টাকার প্রায় ৩০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়। যা পূর্বের বছরের হিসাবে দেখানো হয়। বাকি পুরো টাকা আত্মসাৎ করে পর্ষদ সদস্যরা মিলে।

২০২২ সালে কোম্পানির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২১ কোটি ২৫ লাখ টাকা এফডিআর ছিল। ২০২৩ সালে ওই অ্যাকাউন্টে ছিল ৬১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। ২০ কোটি ৬৩ লাখ টাকার কোনো হদিস নেই। কোথায় কীভাবে খরচ হয়েছে এই টাকা তার কোনো হিসাব পর্যন্ত নেই। এভাবে কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিতে।

সংশ্লিষ্ট সময় কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন বিশ্বজিত কুমার মণ্ডল। এই এমডির নানা দুর্নীতির কারণে আইডিআরএ কর্তৃপক্ষ তাকে অপসারণ করে। অপসারণ চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করায় হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেন। পরে বোর্ড তাকে অব্যাহতি দেয় নিজেদের দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশে।

বোর্ড পরবর্তীতে আরেক দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ আবদুল মতিনকে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেয়। শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সনদ দিয়ে মোহাম্মদ আবদুল মতিনকে এই নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ কাছে সিইওর অনুমোদন চেয়ে আবেদনও করেন। বীমা কোম্পানির শীর্ষ পদে নিয়োগ পেতে এমন জালিয়াতির আশ্রয় নেন তিনি।

আবদুল মতিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তার মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত নিম্নপদে কর্ম অভিজ্ঞতা নেই। এমনকি সবশেষ কর্মস্থল প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে তাকে ছাড়পত্রও দেওয়া হয়নি। পূর্বে কাজ করা একাধিক প্রতিষ্ঠানে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

এই বিষয়ে জানতে কোম্পানির চেয়ারম্যান মো. জামালউদ্দিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মতিনকে ফোন দিলে তারা কেউই কল রিসিভ করেননি।

হোমল্যান্ড লাইফ প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৯৬ সালে। বাংলাদেশের সিলেটস্থ ব্রিটিশ নাগরিক ও স্থানীয় বাংলাদেশীদের নিয়ে গঠন করা হয় কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। তবে প্রবাসী পরিচালকরা ব্রিটিশ নাগরিক হলেও কোম্পানিটিতে তারা বিনিয়োগ করেন বাংলাদেশী হিসেবেই। বিনিয়োগের এই টাকা তারা নিয়ে আসেন হুন্ডি করে। নথিপত্রে এমনটাই তথ্য মেলে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা