September 24, 2024, 1:21 pm


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2024-09-24 11:14:27 BdST

রামপুরায় বড়ভাইকে ‘ছাত্রদের দিয়ে পিটিয়ে হত্যার’ চেষ্টা দুই ভাইয়ের!


ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে রাজধানী ঢাকার স্বনামধন্য 'আল কাদেরিয়া রেষ্টুরেন্ট' এর কর্নধার ফিরোজ আলম সুমনকে ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে হত্যার চেষ্টা চালানোর অভিযোগ উঠেছে আপন দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে।

সর্বশেষ গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে কাজে লাগিয়ে তাকে ‘আওয়ামী লীগ নেতা’ হিসেবে প্রচার চালিয়ে ছাত্রদের দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন বড় ভাই সুমন। তবে অভিযুক্তরা হত্যাচেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই ছাত্রদের খাবার, পানি ও অন্যান্য সহায়তা করে আসছিলেন সুমন। একাধিকবার পুলিশের ধাওয়া খেয়ে ছাত্ররা আশ্রয় নিয়েছিলেন তার রেস্টুরেন্টে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর রাস্তায় দায়িত্ব পালনকারী ছাত্রদের তিনবেলা নিজের রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়ান সুমন। কিন্তু অপতথ্য ছড়িয়ে ছাত্র-জনতাকে উত্তপ্ত করে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছেন তারই আপন ছোট ভাই ইফতিখারুল আমিন।

ঘটনার সূত্রপাত গত ১৪ আগস্ট। আসিফ নেওয়াজ নামের এক ব্যক্তি ফেসবুকে ফিরোজ আলমের কিছু পুরোনো ছবি দিয়ে একটি পোস্ট করেন। সেই পোস্টে লেখা ছিল, ‘আল কাদেরিয়া রেষ্টুরেন্টের মালিক ফিরোজ আলম সুমন সাবেক সরকারের দালাল, আওয়ামী লীগের কর্মী এবং ছাত্র হত্যার সঙ্গে জড়িত।’

ফিরোজ আলমের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবারসহ নানা ধরনের সহায়তা পাওয়া সাধারণ শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে এমন পোস্ট দেখে অবাক হন। এরপর ছাত্ররা খুঁজে বের করেন পোস্টদাতা আসিফ নেওয়াজকে। তারা আসিফ নেওয়াজের কাছে জানতে চান কেন তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন ছবি এবং লেখা পোস্ট করেছেন।

তখন আসিফ নেওয়াজ জানান, এসব ছবি ও লেখা তাকে পাঠিয়েছেন ইফতিখারুল আমিন নামের এক ব্যক্তি। তার কথাতেই এটা ফেসবুকে দিয়েছেন তিনি।

আসিফ নেওয়াজের দাবি, ফেসবুকে তার পোস্ট দেখে ছাত্র-জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে আল কাদেরিয়া রেস্টুরেন্টের মালিক ফিরোজকে গণপিটুনি দেবে। এতে তার মৃত্যুও হতে পারে। এমন পরিকল্পনাই করেছিলেন ইফতিখারুল আমিন। কিন্তু ইফতিখারুল আমিন যে ফিরোজ আলমের ছোট ভাই এটা জানতেন না তিনি।

নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফেসবুক পোস্টটি ডিলিট করে দেন আসিফ নেওয়াজ। এতে ক্ষিপ্ত হন ইফতিখারুল আমিন। বারবার তাকে চাপ দিতে থাকেন আবারও ফেসবুকে পোস্ট দিতে। কথা মতো কাজ না করায় একসময় আসিফ নেওয়াজকে হুমকি দেওয়া শুরু করেন ইফতিখার আমিন ও তার লোকজন। এই ঘটনার পর প্রথমে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং পরে আদালতে মামলা করেন আসিফ নেওয়াজ।

ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া ঢাকা ইম্পেরিয়াল কলেজের  বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীরা এই প্রতিবেদককে বলেন, 'আল কাদেরিয়া রেস্টুরেন্টের মালিক ফিরোজ আলম শুরু থেকেই আমাদের অনেক সহায়তা করে আসছিলেন। তিনি হয়তো ব্যবসায়িক কারণে সাবেক সরকারের বহু মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। কিন্তু তিনি সরাসরি ছাত্রদের আন্দোলনে সমর্থন করেছেন এবং এমনকি প্রশাসনের হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করে নানাভাবে আমাদের সহায়তাও করেছেন।

শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, 'আমরা তার রেস্টুরেন্ট থেকে সহায়তা পেয়েছি অনেক রকমের। এমন সময় গেছে, যখন তিনি দুইবেলা কখনও তিনবেলাও আমাদের খাইয়েছেন। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জেরে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ইফতিখার আমিন আসলে নিজের আপন ভাই ফিরোজ আলমকে হত্যার মতো অবস্থায় ফেলতে চাইছিলেন ছাত্রদের ব্যবহার করে। আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।'

এদিকে, গত ১৯শে আগস্ট রাজধানীর রামপুরা ও বাড্ডা থানায় নিজের দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন সুমন। অভিযোগে উল্লেখ করেন, ছোট ভাই ইফতিখারুল আমিন প্রায় ১৪ মাস ধরে সুমনকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা চালান।

ফিরোজ আলম সুমন

ফিরোজ আলম সুমন একজন সফল রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী। তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি নানা পুরস্কার পেয়েছেন। সুমন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সদস্য। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির প্রথম যুগ্ম মহাসচিব। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন। 

সুমন এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রায় ১৫ বছর আগে আল কাদেরিয়া রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলেন তিনি। খাবারের মানের কারণে এটি দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়, ব্যবসাও প্রসারিত হয়। রামপুরা, মালিবাগ, বসুন্ধরা, গুলশানসহ কয়েকটি এলাকায় রেস্টুরেন্টটির একাধিক শাখা গড়ে ওঠে। কিন্তু করোনার সময় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে কয়েকটি শাখা বন্ধ হয়ে যায়। করোনা শেষে আর্থিক মন্দা কাটিয়ে আবারও ঘুরে দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠানটি। ব্যবসায় আরও ভালো করার জন্য পারিবারিক সিদ্ধান্তে ছোট দুই ভাই ইফতিখারুল আমিন ও হাসনাইন আমিনকে প্রতিষ্ঠানটির দেখভালের জন্য নিজের হাতে গড়ে তোলা ব্যবসায় যুক্ত করেন।

তিনি জানান, দুই ভাইকে ব্যবসায় যুক্ত করার পর হঠাৎ করেই দেখেন— তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটি আরও আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে। দৈনন্দিন হিসাবে গরমিলসহ মাসে অন্তত ৮/১০ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একাধিক বিশ্বস্ত কর্মচারীরাও ভালো ব্যবসার পরও অস্বাভাবিক লোকসানের বিষয়ে নিজেদের সন্দেহের কথা সুমনকে অবহিত করেন।

তখন তিনি গোপনে প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাশ কাউন্টারে আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) ক্যামেরা বসান। এরপর খেয়াল করে দেখেন যে, তার আপন দুই ভাই ক্যাশ কাউন্টার থেকে নগদ টাকা সরিয়ে নিচ্ছেন।

সর্বশেষ, ২০২২ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর ফিরোজ আলম সুমন তার ছোট ভাই হাসনাইন আমিনকে টাকা সরিয়ে নেওয়ার সময় হাতে-নাতে ধরে ফেললে ভাই-ভাইয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এই প্রতিবেদককে সুমন বলেন, আমি চেষ্টা করেছি আমার ভাইদের ব্যবসা শেখাতে। কিন্তু তারা ব্যবসা থেকে উপার্জিত টাকা চুরি করে নিয়ে নিজেরা লাভবান হয়েছে। কয়েক বছর ধরে প্রতিদিন তারা গড়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছে। আমি প্রায় দেড় কোটি টাকা ঋণ করেছি ওই সময়। আমি তাদের বোঝাতে চেয়েছি, কিন্তু তারা আমাকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দিতে চায়।

তিনি বলেন, আসিফ নামে এক যুবককে টাকা দিয়ে ভাড়া করে তারা। আমার বিরুদ্ধে তাকে ফেসবুকে পোস্ট দিতে বলে, যাতে করে ওই পোস্ট দেখে উত্তেজিত হয়ে লোকজন আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এতে তারা দ্বায়মুক্ত থাকতে পারবে। এমন ন্যাক্কারজনক ষড়যন্ত্র তারা করেছিল। এছাড়া আমাকে অসংখ্যবার নানাভাবে হত্যার চেষ্টা করা হয়, সেগুলোও প্রমাণিত।

তিনি আরও বলেন, আসিফ নেওয়াজকে তারা টাকা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে পোস্ট দিতে বলেছে। কিন্তু তারা আসিফকে বলেনি যে, আমি তাদেরই আপন ভাই। এসব বিষয়ে রামপুরা ও বাড্ডা থানায় অভিযোগ করেছি। সেগুলোর তদন্তও হচ্ছে। অন্য একটি মামলায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়নাও জারি রয়েছে।

ফেসবুকে পোস্টদাতা আসিফ নেওয়াজ এই প্রতিবেদককে বলেন, ইফতিখারুলের উদ্দেশ্য ছিল— এই পোস্টের কারণে লোকজন উত্তেজিত হয়ে সুমনের ওপর হামলা করবে। আমাকে সে বলেনি সুমন তার ভাই হন। এছাড়া প্রায় এক বছর ধরে সে আমাকেসহ আরও অনেককে ব্যবহার করে সুমনকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। আমি ইফতেখারুল আমিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছি। সিআইডি ও ডিবি সাইবার ক্রাইম ইউনিট বিষয়টি তদন্ত করছে।

ভাইদের মধ্যে এই দ্বন্দ্বের বিষয়ে জানতে রাজধানীর ভাটারা থানার সাঈদনগরে সুমনদের বাসায় গেলে তাদের বাবা নুরুল আমিনকে পাওয়া যায়নি। পরে ফোনে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি এই ব্যাপারে কোনও কথা বলতে রাজি হননি।

অভিযোগের বিষয়ে ইফতিখারুল আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি দি ফিন্যান্স টুডের প্রতিবেদকের কাছে সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বড় ভাই রাজনীতি ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত। স্বার্থগত কারনে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে অনেকেই তার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। তাছাড়া ফিরোজ আলম আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। তিনি ছাত্র হত্যায় যুক্ত। তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে।

ফিরোজ আলম ছাত্র হত্যায় জড়িত এমন কোনো ছবি, ভিডিও বা প্রমাণ আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার কাছে কোনো ছবি বা প্রমাণ নেই। তবে শুনেছি অনেকের কাছে আছে। রামপুরা এলাকায় খোঁজ নিলেই এই বিষয়ে জানতে পারবেন।

তিনি আরও বলেন, তাছাড়া কেউ ফেসবুকে পোস্ট দিলে আমরা কী করবো। আমাকে সন্দেহ করা ভুল। আমি কেন কাউকে পোস্ট দিতে বলবো?

আসিফ নেওয়াজকে তার ভাই সুমনের লোক বলেও দাবি করেন ইফতিখারুল।

তাদের প্রতিবেশী ইমরান হোসাইন বলেন, আল কাদেরিয়া রেস্টুরেন্টটি সুমন সাহেবের। তিনি তার ভাইদের বসিয়েছিলেন। পরে শুনলাম, তার ভাইরা টাকা-পয়সা আত্নসাৎ করেছে। ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া নিয়েও তাদের মধ্যে গণ্ডগোল হয়েছে। ঘটনাটি নিয়ে থানা পুলিশও হয়েছে। এর বেশি কিছু জানি না।

সাইফুল ইসলাম নামে আরেক প্রতিবেশী বলেন, এক সময় তাদের পারিবারিক সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। বছর খানেক ধরে তাদের সম্পর্ক ভালো না। নানা কারনে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব  সৃষ্টি হচ্ছে বলে শুনেছি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে কার দোষ এটা আমরা ওইভাবে বলতে পারবো না। যেহেতু এটি থানা পুলিশ ও আদালতে গেছে তাই সেখানে গিয়েই সব বলবো।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি ওসমান গনি বলেন, বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি রাষ্ট্রের একটি অন্যতম বড় সংগঠন। তাই বিভিন্ন সময়ে সাবেক সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অনেক ব্যক্তির সাথে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা ও দাবি-দাওয়া নিয়ে বৈঠক/মতবিনিময়/আলোচনা করতে হয়েছে। নিজেদের অনেক ন্যায্য অধিকারের বিষয়ে বরাবরই সুমন বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতেন। সংগত কারণেই সাবেক সরকারের বহু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে একাধিকবার তিনি বৈঠক করেছেন। নানা সমস্যা নিয়ে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে প্রায়শই সাক্ষাৎ করেছেন। এসব বৈঠক/মতবিনিময়/আলোচনা সভার পুরাতন ছবি ব্যবহার করে তারই আপন ভাইয়েরা সুমনকে সাবেক সরকারের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। এমনকি হত্যার ষড়যন্ত্রও করেছে।

ওসমান গনি আরও বলেন, সুমন একজন ভালো ব্যবসায়ী। সে আমাদের সংগঠনের একজন জনপ্রিয় নেতাও। অথচ তার আপন ভাইদের কাছে হেনস্থার শিকার তিনি। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই।

বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা অভিযোগ পেয়েছি। সবগুলো অভিযোগের ব্যাপারে তদন্ত হচ্ছে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা