May 30, 2025, 4:31 am


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2025-05-28 20:20:15 BdST

ঋণখেলাপী হয়েও পরিচালক পদে বহাল অনেকেদুদকের অনুসন্ধান ধামাচাপা দিতে মরিয়া পূবালী ব্যাংক


ডলার কারসাজি, ঋণ জালিয়াতি ও অর্থপাচারসহ নানা অভিযোগে পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, এমডি সহ কয়েক পরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান চলছে। তবে ব্যাংকটির একটি প্রভাবশালী মহল এই অনুসন্ধান ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, অনুসন্ধান তার নিজস্ব গতিতে চলবে। কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা অনুসন্ধান করছেন না।

জানা গেছে, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে পূবালী ব্যাংকে ফ্যাসীবাদের অনুসারী বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান ও সাবেক চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজ আহমদ মজুমদার, ঋণখেলাপী পরিচালক কবিরুজ্জামান ইয়াকুব, ফাহিম আহমদ ফারুক চৌধুরী সহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে একটি অনুসন্ধান শুরু হয়। কমিশনের সহকারী পরিচালক হাফিজুর রহমানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে নোটিশও প্রদান করেছে দুদক।

অভিযোগের বিবরণ থেকে জানা গেছে, পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনঞ্জুরুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ আহমদ মজুমদার ও পরিচালক কবিরুজ্জামান ইয়াকুব বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাকে তাদের অনুকুলে নেয়। যাদের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন নিয়ম বহির্ভূত কাজ চালিয়ে আসছিলেন।

বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, অভিযুক্তরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক খুরশিদ-উল-আলমকে হাত করে ব্যাংকটির যাবতীয় অবৈধ কার্যকলাপ পরিচালিত করতো। বিনিময়ে খুরশিদ-উল-আলমকে পূবালী ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি দীর্ঘদিন ব্যাংকটির স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন। অপর স্বতন্ত্র পরিচালক নওশাদ আলী চৌধুরীও পূর্বসুরীর মতোই আজ্ঞাবহ হয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান মনঞ্জুরুর রহমান ও সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ আহমদ মজুমদারের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন।

এছাড়া পূবালী ব্যাংকের পরিচালক কবিরুজ্জামান ইয়াকুব দীর্ঘদিন যাবত উক্ত ব্যাংকেরই একজন বড় ঋণখেলাপী। বর্তমানে তার চন্দ্রা স্পিনিং মিলের নামে ঋণ আছে প্রায় ১৩২ কোটি টাকারও বেশি। চন্দ্রা স্পিনিং মিলের নামে নেওয়া ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় হাফিজ আহমদ মজুমদার ঋণের সুদ মওকুফ করে ৬৫ কোটি টাকা দেওয়ার জন্য পরামর্শ দেন, কিন্তু উক্ত টাকাও পরিশোধ করতে কবিরুজ্জামান ইয়াকুব ব্যর্থ হন।

এতো সাহায্য সহযোগিতা করার পরও উক্ত চন্দ্রা স্পিনিং মিলের নামে নেওয়া ঋণ পরিশোধ না করা সত্ত্বেও অদৃশ্য ক্ষমতাবলে তিনি পরিচালক পদে আছেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকও কোনও রহস্যজনক কারনে কবিরুজ্জামান ইয়াকুবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

এছাড়া আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী, স্বতন্ত্র এমপি ও গার্মেন্টস ব্যবসায়ী এ কে আজাদ সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ মজুমদারের একজন ঘনিষ্ঠ। তিনি হাফিজ মজুমদারের গার্মেন্টসে বিভিন্ন সাহায্য করে আসছেন। বিনিময়ে তাকে পূবালী ব্যাংকের শেয়ার কিনতে সাহায্য করে পূবালী ব্যাংকের প্রায় ১১ শতাংশ শেয়ার ক্রয় করান তার গার্মেন্টসের নামে। হাফিজ মজুমদার নিজ উদ্যোগে এ.কে আজাদের বিশেষ প্রতিনিধি জনৈক আব্দুর রাজ্জাক মন্ডলকে পূবালী ব্যাংকের পরিচালক করেছেন।

মনঞ্জুরুর রহমান, হাফিজ আহমদ মজুমদার ও এ কে আজাদ পূবালী ব্যাংকের শেয়ার কিনে এস আলম গ্রুপের মত নিজেরাই এই ব্যাংকটিকে কুক্ষিগত করার পরিকল্পনা করেছেন।

অভিযোগ থেকে আরও জানা গেছে, ফ্যাসিবাদী সরকারের সময়ে সরকারের বিভিন্ন মহলকে হাত করে মঞ্জুরুর রহমান ব্যাংকের চেয়ারম্যান হন। তিনি চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে তার সহায়ক দুর্নীতিবাজ কয়েকজন পরিচালকদের নিয়ে ব্যাংকটিতে ব্যাপক লুটপাট ও দুর্নীতি করেন। যার পরিণতিতে ব্যাংকটির বর্তমানে করুণ ও ভয়ানক চিত্র ফুটে উঠেছে।

মঞ্জুরুর রহমান পূবালী ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডার ডেল্টা লাইফ ইন্সুরেন্স থেকে সরে আসার পর সেখানে হাফিজ আহমদ মজুমদারকে চেয়ারম্যান এবং এ কে আজাদের ছেলেকে পরিচালক পদে বসান। এছাড়াও হাফিজ আহমদ মজুমদার ও মঞ্জুরুর রহমান যাকে ইচ্ছা পূবালী ব্যাংকের চাকরী দিয়েছেন কোনও রকম যোগ্যতার বাছবিচার ছাড়াই। ব্যাংকে কে থাকবে আর কে থাকবে না সেটা তারা নিজেরা ইচ্ছেমতো নির্বাচন করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি বার্ষিক সাধারণ সভার আগে প্রক্সি ভোট ব্যাংকের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান বা হাফিজ আহমদ মজুমদারের নিকট জমা দেওয়ার একটা অদ্ভুত নিয়ম চালু করা হয়। আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক এমপি হাফিজ মজুমদার ও মঞ্জুরুর রহমান এই নিয়ম চালু করেন। এর আসল কারন হলো যাতে তারা তাদের নিজস্ব পছন্দের লোকদের বোর্ডের পরিচালক বানিয়ে আজ্ঞাবহ করে রাখতে পারেন। অথচ তারা ব্যাংক থেকে বিএনপির সাবেক এমপি শফি উদ্দিন চৌধুরী ও তার ভাই সাবেক আইজিপি ই-এ চৌধুরীকে পরিচালক থেকে সরিয়ে দেন। কারন তারা বোর্ডে উপস্থিত থাকলে এই অসাধু চক্রের দুর্নীতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এইভাবেই এক পর্যায়ে তারা ভোট কুক্ষিগত করে শফি উদ্দিন চৌধুরীকে বোর্ড থেকে অপসারণ করে।

অভিযোগের বিবরণ মতে, পূবালী ব্যাংক ১৯৮৬ সালে ব্যক্তি মালিকানায় আসার পর পরিচালনা পর্ষদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানের কারনে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একটি সফল ব্যাংকে পরিণত হয়। এরপরই ব্যাংকখেকো দুর্নীতিবাজদের কুদৃষ্টি পড়ে পূবালী ব্যাংকের ওপর। নামে বেনামে ব্যাংকের সিএসআরএম ফান্ড থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। চন্দ্রা স্পিনিং মিলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ন্যুনতম যাচাই-বাছাই না করেই কোটি টাকা ঋণ প্রদান করে। যার ফলে পূবালী ব্যাংকে ঋণ খেলাপির সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। ব্যাংকের ক্যাশ ফ্লো কমতে থাকে।

দূর্নীতিবাজ এই সিন্ডিকেট চক্রের অন্যতম হোতা হাফিজ আহমেদ মজুমদার বিগত আওয়ামী সরকারের চিহ্নিত দোসর হয়েও অদ্যাবধি বহাল তবিয়তে ব্যাংকে খবরদারি করে যাচ্ছেন এবং তার সাথে আছেন এ কে আজাদ ও বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান।

দুদকের অভিযোগে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের মাধ্যমে ঋন দেওয়ার বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান বলেন, আমরা অনুসন্ধান শুরু করেছি। কয়েকটি দপ্তরে ও অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিঠি দিয়ে বক্তব্য চাওয়া হয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি।

অভিযোগের বিষয়ে পূবালী ব্যাংকের বর্তমান এমডি মোহাম্মদ আলী বলেন, দুদক অনুসন্ধান করছে। তাদের চাহিত তথ্য দেয়া হচ্ছে। দেখা যাক তারা কি প্রতিবেদন দেয়। পূবালী ব্যাংকের অনুসন্ধান ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার করেন মোহাম্মদ আলী।

দুর্নীতি দমন কমিশনের চলমান এই অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ আহমদ মজুমদার এবং পরিচালক কবিরুজ্জামান ইয়াকুবের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.