ড. মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দিন
Published:2025-09-02 17:28:08 BdST
জামাতের গা ছুঁচোর গন্ধ বনাম নির্বাচন বানচালের নতুন তত্ত্ব "পিআর"
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী সবসময় বিতর্কিত এক অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা, পরবর্তীতে সামরিক শাসনের সুযোগে পুনর্বাসন, কখনো বিএনপির মিত্র আবার কখনো আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত—সব মিলিয়ে দলটি সবসময়ই “গিরগিটির মতো রঙ বদলানো” বলে সমালোচিত।
বিএনপির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে জামায়াতে ইসলামী বার বার আওয়ামী লীগের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আঁতাত করে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আবারও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তাদের দ্বিমুখী ভূমিকাকে ঘিরে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে।
বিএনপিকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে “জামাত-আওয়ামীর আঁতাত” কিংবা তাদের নতুন রাজনৈতিক প্রজেক্ট “পি আর” এর আলোচনা এখন সর্বত্র।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার বিরোধিতা করে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন—জামাতের সেই ভূমিকা ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। স্বাধীনতার পর দলটি নিষিদ্ধ হয় কিন্তু ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর যখন বহুদলীয় রাজনীতি চালু হয়, তখন জামাতও পুনর্বাসনের সুযোগ পায়। বিএনপি জামাতকে এই দেশে পুনর্বাসিত করে ছিলো এমন অভিযোগ আওয়ামী লীগের । অভিযোগটি আংশিক সত্য হলেও বিএনপিকে তার ঘাত প্রতিঘাত সইতে হয়েছে অনন্তকাল। এখান থেকেই শুরু তাদের নতুন খেলা।
১৯৮০’র দশকে এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিএনপি নেতৃত্ব দেয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। প্রাথমিকভাবে জামাতও আন্দোলনে ছিলো, কিন্তু ১৯৮৬ সালে তারা হঠাৎ এরশাদের নির্বাচনে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এতে আন্দোলনের পিঠে ছুরি মারা হলো। তখন জামাতের নেতারা বলেছিলো “১৯৭১ সালের বিতর্কিত ভূমিকার জন্য আমাদের গায়ে ছুঁচোর গন্ধ আছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকলে সেই গন্ধ থাকবে না।” কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, সেই সংসদ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল আন্দোলন চালিয়ে গেলে অবশেষে ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন হয়।
এরশাদের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়। বিএনপি জয়ী হলেও মাগুরা-১ আসনের উপনির্বাচনের কারচুপি বিতর্কের পর আওয়ামী লীগ ও জামাত একসাথে আন্দোলন শুরু করে। তখন মরহুম গোলাম আযমসহ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সরাসরি যুক্ত ছিলেন। যদিও দলটির ভেতরের অনেকেই এই ঐক্যের বিরোধিতা ছিলো, অনেকে দলত্যাগও করেছিলো। তবে যেসব নেতারা আওয়ামী লীগের সাথে আতাতের জন্য অতি উৎসাহী হয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলো পরবর্তীতে তাদেরকেই টার্গেট করে করে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ছিল আওয়ামী লীগ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানে যুক্ত করার পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জামাত এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তাদের স্লোগান ছিলো—“তিন দলের খেলা শেষ, জামাত ইসলামের বাংলাদেশ।” ফলাফল হলো ভিন্ন—জামাত পেল তিনটি ও বিএনপি ১১৬টি, জাতীয় পার্টি ৩২টি, জাসদ রব ১টি, ইসলামী ঐক্য জোট ১টি, স্বতন্ত্র ১টি এবং আওয়ামীলীগ ১৪৬টি আসনে জয় লাভ করে। ২৩ জুন জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে।
১৯৯৬ সালের মে মাসে সেনাপ্রধান নাসিমের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। জনশ্রুতি ছিল, এর পেছনে জামাত-আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র” এর হাত ছিলো। লক্ষ্য ছিলো খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়া। যদিও এ ঘটনা প্রমাণিত হয়নি, তবে রাজনৈতিক মহলে এটি আজও আলোচিত।
জামাতের সাথে বিএনপির আসন বন্ঠন ও মন্ত্রীত্ব নিয়ে সমঝোতা হওয়ায় ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসে। যে কারণে জামাতের উপর আওয়ামীলীগ ভীষন ক্ষীপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় থেকেই শুরু হয় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের নতুন ধাপ। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, দেশজুড়ে একযোগে সিরিজ বোমা হামলা, বাংলা ভাইয়ের উত্থান, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা—এসব ঘটনায় বিএনপি-জামাতকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদী শক্তি হিসেবে বিশ্বের দরবারে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনৈতিক চাপ বাড়তে থাকে। অবশেষে ২০০৭ সালে ১/১১’র মাধ্যমে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয়।
১/১১ পরবর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য ছিলো বিএনপিকে দুর্বল করা এবং খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়া। জিয়া পরিবারকে নিয়ে নানা কুৎসা রটানো হয়, কারাবন্দি করা হয়, আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর মতো হৃদয়বিদারক ঘটনাও ঘটে। বিএনপি তখন নির্বাচনে অংশ নিতে চাইছিলো না, কিন্তু জামাতের জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত অংশ নেয়। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হয়।
২০০৮ সালে ফখরুদ্দিন- মইনউদ্দিনের তত্বাবধানে ও ভারতের "র" প্রযোজিত নীল নকশার নির্বাচনের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় যায় এবং গণতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে তদস্থলে মহাপ্রক্রমশালী এক স্বৈরাচারী সরকারের যাত্রা শুরু হয়। সেই সঙ্গে শুরু হয় গনহত্যা, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিচারিক হত্যাসহ গানপাউডার দিয়ে মানুষ হত্যা করে তার দায় বিরোধী দলের উপর তার দায় চাপিয়ে দেয়ার এক সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা।
বিরোধী দলের আন্দোলন দমন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, ফাঁসি—সবকিছুতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা প্রকট হয়।
অবশেষে ১৭ বছর পর ছাত্র জনতা গনন্দোলনে "ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী সরকারের পতন হলে তার ক্রেডিট লুট করে নেয় "জামাতে ইসলামী বাংলাদেশ"। অথচ বিগত স্বৈরশাসকের সময় জামাত তাদের গুপ্ত বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছাত্র জনতার গণআন্দোলন বার বার রুখে দিয়েছে। এ সময় ছাত্র সমাজের আন্দোলনে জামাত নিজেদের কৃতিত্ব দেখাতে চায়, অথচ বাস্তবে অনেক সময় তারা স্বৈরশাসকের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো।
বর্তমানে নির্বাচনকে ঘিরে নতুন এক রাজনৈতিক প্রজেক্টের আলোচনা চলছে—“পি আর”। ভোট গণনায় PR = Proportional Representation বা "আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব" বলতে আমরা নির্বাচনী ব্যবস্থায় PR বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন পদ্ধতি। এখানে একটি দল সংসদে কয়টি আসন পাবে তা তাদের প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতিক হিসেবে নির্ণয় হবে। যেমন: ৩০০ আসনের মধ্যে যদি কোনো দল ৩০% ভোট পায়, তাহলে তারা প্রায় ৯০টি আসন পাবে। এতে ছোট দলগুলোও ভোট অনুযায়ী সংসদে প্রতিনিধিত্ব পায়। ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকার অনেক দেশ এই পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে “পি আর” আসলে Proportional Representation (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) বোঝাচ্ছে। এর মানে হচ্ছে—নির্বাচনে সরাসরি “একজন প্রার্থী বনাম একজন প্রার্থী” নয়, বরং জনগণের দেওয়া মোট ভোটের আনুপাতিক হিসাবে দলগুলো সংসদে আসন পাবে। বাংলাদেশে বর্তমানে “First Past the Post” বা একজন প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পেলেই জয়ী—এই ব্যবস্থা চালু আছে। কিন্তু “পি আর” ব্যবস্থা চালু হলে দলগুলোর আনুপাতিক ভিত্তিতে সংসদে আসন ভাগ করা। “পি আর” পদ্ধতির ভালো এবং মন্দ দিক আছে। একটি দল তাদের প্রাপ্ত মোট ভোটের অনুপাতিক হিসেবে পাওয়া আসন নিজেদের পছন্দমত ব্যাক্তিদের বা আতমীয় বন্ধু বান্ধবের মধ্যে বিলি বা বিক্রি করে দিতে পারে। যেহেতু প্রার্থী সরাসরি জনগণ কর্তৃক নির্বাচীত হয়না, সেহেতু জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা থাকার কথা না।
বিশ্লেষকদের মতে, “পি আর” পদ্ধতি মূলত বিএনপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার একটি অপকৌশল। আওয়ামী লীগ ও জামাত পরস্পরের বিরোধী বললেও বাস্তবে নানা আঁতাতের মাধ্যমে তারা বিএনপিকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে সরকার ও জামাতের ছত্রছায়ায় “এনসিপি” নামের নতুন একটি দল আত্মপ্রকাশ করেছে। তাদের অবস্থানও বিএনপির বিরুদ্ধে। একইসাথে বিশাল সাইবার টিম সক্রিয় করা হয়েছে, যাতে বিএনপিকে বিভ্রান্ত ও দুর্বল করা যায়।
বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা “র” দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তার করছে—এ অভিযোগ নতুন নয়। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি বা অন্য কোনো দলকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগকে আবারও ক্ষমতায় আনতে ভারত দৃঢ়ভাবে মাঠে নেমেছে। স্বৈরাচার আওয়ামীলীগ দল হিসেবে নিষিদ্ধ কিন্ত তাদের বিশাল অংকের ভোটাররা সক্রিয়। জামাত শিবির ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পাগল প্রায়। তারা আওয়ামীলীগের জনসমর্থন তাদের অনুকূলে টেনে/হিন্দু জামাত তৈরি করেছে। সেই সঙ্গে বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে বিশাল সাইবার টিম সক্রিয় করেছে। ইতিমধ্যে সরকার ও জামাতের ছত্রছায়ায় "এনসিপি" নামক একটি দল যাত্রা শুরু করেছে। এরাও বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অর্থাৎ বিএনপি যেন কোন অবস্থায় ক্ষমতায় না আসতে পারে তার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়ে গিয়েছে। কিন্ত বিএনপিকে মাইনাস করার ফলাফল যে হিতে বিপরীত হতে পারে - তা অচিরেই তারা হাড়ে হাড়ে টের পাবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি আজও ত্রিমুখী: আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামাত। তবে বাস্তবতা হলো—জামাত কখনো বিএনপির প্রকৃত বন্ধু নয়, আবার আওয়ামী লীগেরও নয়। তারা কেবল নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থে সুযোগ খোঁজে। “ছুঁচোর গন্ধ” তত্ত্ব আজও বহাল আছে। ১৯৮৬ সালে যেমন আওয়ামী লীগের সঙ্গে মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে তারা বলেছিলো—“এতে আমাদের গন্ধ থাকবে না”—তেমনি আজও নতুন কৌশল খুঁজছে।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ভারতের "র" তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে ফেলেছে। তারা জাতীয় পার্টি কিংবা অন্যকোন দলের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে। অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বে নতুন জোট, জামাতে ইসলামীর নেতৃত্বে ইসলামী জোট, এনসিপি ও সমমনা দল নিয়ে আরও একটি জোট নির্বাচনে আসবে। সেই আয়োজনে ফলাফল কি হতে যাচ্ছে তা কেউ না জানলেও উতিমধ্যে জনমনে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু দেশের মানুষকে মনে রাখতে হবে দেশপ্রেমে বলীয়ান "বিএনপির বিকল্প একমাত্র বিএনপি"।
বাংলাদেশের মানুষের মনে রাখা জরুরি: দেশপ্রেমে বলীয়ান রাজনৈতিক শক্তি যদি না থাকে, তবে বিদেশি প্রভাব, গোপন আঁতাত ও স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদের হাতে দেশ বারবার প্রতারিত হবে। বিএনপির বিকল্প যদি বিএনপি-ই হয়, তবে সেটি প্রমাণ করতে হবে শক্তিশালী সংগঠন, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এবং জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে। যার প্রানন্তর প্রচেষ্টা চলছে অবিরত।
॥ ড. মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দিন এমবিই এমইনস্টএফ আন্তর্জাতিক গবেষক, রাজনীতিবিদ, লেখক এবং কলামিস্ট; সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান, বিএনপি যুক্তরাজ্য শাখা (ওয়েস্ট মিডল্যান্ডস)
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.