শাহীন আবদুল বারী
Published:2025-09-07 23:22:23 BdST
রূপপুর প্রকল্পে বিতর্কিত ড. জাহেদুলকে আবার এমডি নিয়োগের পায়তারা!
দেশের সবচেয়ে বড় ও স্পর্শকাতর অবকাঠামো পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না নির্মাণাধীন এই প্রকল্পের। নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি, ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসন, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর চরদের চাকরি দেওয়া নিয়ে সমালোচনার পর জানা গেল নতুন অপতৎপরতার তথ্য।
সূত্র মতে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে আবারও আলোচনায় এসেছেন প্রকল্প পরিচালক ও এনপিসিবিএল-এর অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. জাহেদুল হাছান।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিস্ট সরকার-এর আস্থাভাজন কর্মকর্তা হিসেবে চুক্তি ও পদবিন্যাসে মূল ভূমিকা পালন করেছেন। তার অতীত বিশ্লেষণ না করে তাকে এমডি পদে নিয়োগ দিতে মরিয়া একটি গোষ্ঠী।
২০২৪ সালের ১৫ মে ভারতীয় হাইকমিশনের সুপারিশ ও শেখ রেহানার ঘনিষ্ঠ মহলের আশীর্বাদে তাঁকে প্রকল্প পরিচালক করা হয়। পরবর্তীতে ২০২৫ সালের ২৮ মে রাষ্ট্রায়ত্ত নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (এনপিসিবিএল) অন্তর্বর্তীকালীন এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
তবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এই নিয়োগ সরকারি চাকরি আইন ও পরমাণু শক্তি কমিশনের বিধিমালা লঙ্ঘন করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, ৩১ মে থেকে ড. হাছান অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) ছিলেন। এই অবস্থায় রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ছাড়া নিয়োগ বৈধ নয়, অথচ অনুমোদন ছাড়াই তাঁকে এমডি করা হয়। এর ফলে তার বর্তমান এমডি পদে দায়িত্ব পালন আইনগতভাবে পুরোপুরি অবৈধ।
এই বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও এনপিসিবিএল বোর্ড সদস্য মঈনুল ইসলাম তিতাসের নামও আসছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি ড. হাছানকে এমডি পদে রাখতে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। বিস্তর অভিযোগ থাকার পরেও জাহেদুল হাছানকেই এমডি হিসেবে রাখার জন্য “জাহেদুল হাছানের বিকল্প নেই” তত্ত্ব রটাচ্ছেন।
প্রকল্পে শিগগিরই তিনটি নতুন চুক্তি (অপারেশন, মেইনটেন্যান্স ও স্পেয়ার পার্টস) স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের দাবি, এসব সেবার জন্য আলাদা কোনো চুক্তির প্রয়োজন নেই। কারণ এগুলো আগেই রাশিয়ার সঙ্গে বিদ্যমান জেনারেল চুক্তির মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত।
তাদের মতে, নতুন চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্দেশ্য হলো অতিরিক্ত ব্যয়ের সুযোগ সৃষ্টি করা। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কয়েক শ বিদেশি বিশেষজ্ঞকে উচ্চ বেতনে নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যা প্রকল্প ব্যয়কে অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে তুলবে এবং জাতীয় স্বার্থকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পরও এনপিসিবিএল কার্যকর করা হয়নি। এতে দীর্ঘমেয়াদে স্থানীয় জনবল গড়ে তোলার উদ্যোগ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বরং বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ভবিষ্যতে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, তিনি তিন শতাধিক প্রশিক্ষিত প্রকৌশলীকে ছাঁটাইয়ের পরিকল্পনাও করেছেন।
রূপপুর প্রকল্পে যত অনিয়ম
রূপপুর প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। ২০২৪ সালের আগস্টে প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে প্রকল্পে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের দুর্নীতির তথ্য উঠে আসে। পরে দেশের গণমাধ্যমেও বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।
প্রকল্পের বাজেট শুরুতে ৮ বিলিয়ন ডলার থাকলেও বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ বিলিয়ন ডলারে। অডিট রিপোর্টে বাজেট বৃদ্ধির যৌক্তিক কাগজপত্র না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রাশিয়া থেকে যন্ত্রপাতি আমদানিতে অস্বাভাবিক দাম নির্ধারণের সঙ্গে ড. হাছান সম্পৃক্ত ছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, একইসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক, এমডি, স্টেশন ডিরেক্টর ও মানবসম্পদ প্রধানের দায়িত্ব পালন করে ড. হাছান পুরো প্রকল্পকে একক নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। তিনি একদিনে ১৮৬টি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে রেকর্ড করেছেন। এছাড়া সরকারের শত কোটি টাকা ব্যয়ে প্রশিক্ষিত ১৮ জন অভিজ্ঞ প্রকৌশলী ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে বিনা কারণে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন, আরও ১১ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
অভিযোগকারীদের দাবি, অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা দায়িত্বে থাকলে ১৩ বিলিয়ন ডলারের ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ হয়ে যেত। তাই তাদের সরিয়ে রেখে ড. হাছান প্রকল্পকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছেন।
৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর প্রকল্পের ভেতরে ড. হাছানের কার্যকলাপ আরও বিতর্ক তৈরি করেছে। কর্মকর্তারা অনিয়ম নিয়ে সরব হলে তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে শোকজ নোটিশ দেন, অনেককে বরখাস্ত করেন এবং প্রকল্পে প্রবেশে বাধা দেন। অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে।
ড. জাহেদুল হাছানের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান
অবৈধভাব এমডি হিসেবে দায়িত্ব দখলে নেওয়া, আর্থিক অনিয়ম ও দূর্নীতি, কর্তৃত্ববাদী আচরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও অন্যান্য সংস্থা ইতোমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে। পাশাপাশি ক্যাব (ভোক্তা অধিকার সংগঠন) থেকেও ড. হাছানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
প্রকল্প এখনও জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারেনি। যন্ত্রপাতি স্থাপন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন না হওয়ায় কার্যক্রমে আরও সময় লাগবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের কাজ প্রায় আড়াই বছর পিছিয়েছে। এর মধ্যে প্রতিদিন বাংলাদেশকে রাশিয়াকে ঋণের সুদ হিসেবে ১০ কোটিরও বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও নেতৃত্বের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে রূপপুর প্রকল্প অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছে। তাদের মতে, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও অভিজ্ঞ প্রযুক্তিবিদদের পুনর্বহাল না হলে এই প্রকল্প জাতীয় স্বার্থের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
যথাযথ নিয়ম না মেনে নিয়োগ দেয়া দেশের সর্ববৃহৎ মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নতুন করে ড. জাহেদুলের নিয়োগ প্রক্রিয়ার খবরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকে।
তারা বলেছেন, বিগত সময়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়া ড. জাহেদুল হাসানের বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতি, অনিয়ম, চরম অব্যবস্থাপনার বিভিন্ন অভিযোগ। শুধু তাই নয় ড. জাহেদুল হাসান পতিত সরকারের দোসর। তিনি শেখ রেহানার আশীর্বাদপুষ্ট একজন আমলা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতিত সরকারের পক্ষে তার ছিলো অটুট সমর্থন। নগদ টাকা খরচ করেছেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিপক্ষে। এখনো হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তার হীন মানষিকতা রয়েছে।
পূর্ণাঙ্গ এমডি হিসেবে থাকতে প্রভাব খাটানোর অভিযোগের বিষয়ে জানতে ড. জাহেদুলের মোবাইল ফোনে একাধিক দিন কল দিলেও তিনি লাইন কেটে দেন। এমনকি দি ফিন্যান্স টুডের বিশেষ প্রতিনিধি'র পরিচয় দিয়ে তার হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দেয়া হলেও তিনি যোগাযোগ করেননি।
প্রকাশ্যে সিন্ডিকেট বাণিজ্য করা এই ব্যক্তি আবারও এমডি পদে নিয়োগ পেলে তা হবে একজন বিশ্বাসঘাতককে প্রতিষ্ঠিত করা।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.