August 10, 2025, 12:39 am


শাহীন আবদুল বারী

Published:
2025-08-09 16:50:04 BdST

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীবিএনপির বাতিঘর খালেদা জিয়া


ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তার স্বামী জিয়াউর রহমান ছিলেন রাষ্ট্রপতি। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বয়স এখন ৮২ বছর। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের রোষানলের মামলায় দীর্ঘদিন কারাবরণ করেছেন। শারীরিক অসুস্থতায় জর্জরিত থেকেও বিএনপির হাল ধরে রেখেছেন। বিএনপি সহ বিভিন্ন শ্রেণির পেশার মানুষ খালেদা জিয়াকে আরেক বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চায়। এরমূলে হচ্ছে, তিনি আরেক বার প্রধানমন্ত্রী হলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা আরো উজ্জীবিত হবে। দলের মধ্যে যে কোন্দল আছে তা কমে যাবে।

গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মিথ্যা ও বানোয়াট সব মামলা থেকে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এরপর লন্ডনে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হোন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ায় দেশব্যাপী নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্যতা ফিরে এসেছে। ইতোমধ্যে নেতাকর্মীদের সঙ্গে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কুশল বিনিময় শুরু করেছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে ।

গত ৫ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের ঘোষণা দেয়ার পর বিএনপি অনেক টাই নড়েচড়ে বসেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া স্পষ্ট নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আসন্ন নির্বাচনে কোন বিতর্কিত ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়া হবে না। এ প্রসঙ্গে দলীয়ভাবে কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতীতের তুলনায় এবার যোগ্যতা, সততা ও মেধাবীদের মনোনয়নের প্রাধান্য দেয়া হবে। তবে হাইকমান্ডের বেশ কিছু নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। তারা মনোনয়ন পাবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আবার অনেককে ডেকে সতর্কবার্তাও দেয়া হয়েছে। কোনো বিরোধে না জড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া।

এরপরই রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। খালেদা জিয়ার এমন আহ্বানে নেতাকর্মীরা সাধুবাদ জানিয়েছেন। সারা দেশে ভোটের হাওয়া শুরু হয়েছে। তবে মনোনয়ন পেতে যারা মরিয়া তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা সঠিক ভাবে যাচাই-বাছাই করার দাবি জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ। গত ১৭ বছর যারা জেল-জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তারা যেন মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত না হোন সেবিষয়ে সরাসরি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন নির্যাতিত মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিএনপি নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভোটের পরিবেশ তৈরি এবং রাজনীতিতে একটা স্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি, এসবই সম্ভব হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আন্তরিক হস্তক্ষেপ ও যোগ্য নেতৃত্বে। আবার কেউ কেউ বলছেন, খালেদা জিয়া এখন অনেকটা সুস্থ হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বর্তমান রাজনীতিতে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। শুধু তাই নয়, বেগম জিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয়তায় বিএনপি এখন অনেকটাই চাঙ্গা। গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের বাসভবন ফিরোজায় প্রতিদিন নেতাকর্মীরা সাক্ষাৎ করছেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে। নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ও করছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তার রাজনীতিতে এমন সক্রিয়তা দলের নেতাকর্মীদের অনেক চাঙ্গা করে তুলেছে। খালেদা জিয়া পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে দেশের রাজনীতি ও উন্নয়নে আরও ভূমিকা রাখবেন।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, ম্যাডাম আগের চেয়ে এখন অনেকটা ভালো আছেন। তবে, এখনও পরিপূর্ণ সুস্থ হননি। তিনি হাসলে বাংলাদেশ হাসে। বিএনপি নেতাকর্মীদের আশার জায়গা ও বাতিঘর হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়া। সম্প্রতি রাজনীতিতে তার কিছুটা সক্রিয়তায় নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। আমাদের প্রত্যাশা তিনি আরও সক্রিয় হবেন এবং আগের মতো দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

দলীয় সূত্রমতে, ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয়, তখন খালেদা জিয়া ছিলেন একজন গৃহবধূ। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে তখন ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন খালেদা জিয়া। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তখন বিপর্যস্ত এবং দিশাহারা। জিয়াউর রহমান পরবর্তী দলের হাল কে ধরবেন, সেটি নিয়ে নানা আলোচনা চলতে থাকে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন আব্দুস সাত্তারের বয়স আনুমানিক ৭৮ বছর। বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের বার্ধক্য এবং দল পরিচালনা নিয়ে অসন্তোষের কারণে তৎকালীন বিএনপির একাংশ খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু রাজনীতির প্রতি খালেদা জিয়ার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। একপর্যায়ে দলের নেতাকর্মীরা রাজনীতিতে আসার জন্য দিনের পর দিন খালেদা জিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি দলের হাল না ধরলে দল টিকবে না বলেও অনেকে বলেন। বর্তমান পরিস্থিত বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ থাকলেও তিনি তিনি আগের মতোই বিএনপিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। যার কারণে দলের নেতাকর্মীরা চাচ্ছেন তিনি আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিয়ে আরেক বার প্রধানমন্ত্রী হোক।

তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে খালেদা জিয়া আত্মপ্রকাশ করেন।
সেদিন তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেন। একই বছর ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে খালেদা জিয়া প্রথম বক্তব্য রাখেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন এবং এপ্রিল মাসের প্রথমে বিএনপির এক বর্ধিতসভায় তিনি ভাষণ দেন। সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কয়েকমাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এ সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। এরপর ১৯৮৪ সালের ১০ মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

১৯৮০ দশকে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশজুড়ে খালেদা জিয়ার ব্যাপক পরিচিত গড়ে উঠে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে বিএনপি জয়লাভ করে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। শুধু তাই নয়, খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে যতগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তার সবগুলোতেই জয়লাভ করেছেন। ১৯৯৬ সালে আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসলে খালেদা জিয়ার দ্বিতীযবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু সেবার আন্দোলনের মুখে বিএনপি বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে খালেদা জিয়া তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল বিএনপির ব্যাপক ভরাডুবি হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অনেকটা চাপে পড়ে যায়। খালেদা জিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয়, তার বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলা। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ার কারণে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে খালেদা জিয়া অংশ নিতে পারেননি। দেশে-বিদেশে সে নির্বাচন প্রবল বিতর্কের মুখে পড়ে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে বেগম জিয়া সরকারের নির্বাহী আদেশে কারাগারের বাইরে ছিলেন। যদিও এজন্য তাকে নানা বিধিনিষেধ পালন করতে হয়। যার মধ্যে ছিল- রাজনীতিতে অংশ না নিতে পারা, কোনো ভাষণ বা বক্তব্য না দেওয়া, বিদেশ যেতে না পারা ইত্যাদি। এরপর গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক আওয়ামী লীগের পতনের পর মামলা থেকে খালাস পেয়ে লন্ডনে উন্নত চিকিৎসার জন্য যান। চিকিৎসা শেষে গত কোরবানির ঈদের আগে দেশে ফেরেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এরপরই রাজনীতিতে সক্রিয় হতে শুরু করেন তিনি।

সূত্রমতে, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর যে কোন সময়ের চেয়ে দেশ বর্তমানে এতটাই দেশীয় ও বিদেশীয় চক্রান্তের শিকার হয়েছে তা সকল জনগোষ্ঠীকে অনুধাবন করতে হবে। সে অনুযায়ী উত্তরনের পথ খুঁজে বের করে কালক্ষেপণ না করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এ গুরু দায়িত্বটা দেশের বৃহত্তম এবং সর্বাধিক জনসমর্থিত দল বিএনপি কেই অগ্রনী ভুমিকা পালন করতে হবে। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিএনপিকে সুসংগঠিত করা, বিগত সৈরাচার হাসিনা সরকারের আমলে যারা গুম,খুন, জেল-জুলুম ও মিথ্যা মামলার হয়রানির শিকার হয়েছন সেই ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন এখন সময়ের দাবী। প্রবীন ও নবীনের একটা চমৎকার সমনয় দরকার। তা না হলে বিএনপি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি জনগণের আশা আকাংকাক্ষা ধূলিসাস্ত হয়ে যাবে, দেশ তলিয়ে যাবে অন্ধকারাচ্ছন্নে। বিগত সৈরাচার সরকারের আমলে যারা জেল-জুলুম, মিথ্যা মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন তাদেরকেও দলকে পরিচ্ছন্ন রাখতে আরো ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।বিগত সৈরাচার সরকারের কার্যকলাপ ও পরিনতি উপলব্ধি করে লুটতরাজ, রাহাজানি, সম্পদ লুন্ঠন এবং জনগণের মালের নিরাপত্তা রক্ষায় শহীদ জিয়ার সৈনিকদের সন্মুখ কাতারে থাকতে হবে। এতে করে দলের ভাবমূর্তি যেমন অক্ষুণ্ন থাকবে, তেমনই দেশ হবে একটা সমৃদ্ধ, সনির্ভর ও দূবৃত্তপরায়নমুক্ত।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.