নেহাল আহমেদ, রাজবাড়ী
Published:2023-12-13 15:29:56 BdST
রাজবাড়ী জেলার গণহত্যা: পেক্ষাপট ১৯৭১
রাজবাড়ী জেলায় সমস্ত দেশের মধ্যে ছিল একটু ভিন্ন পেক্ষাপট। এখানে প্রচুর বিহারীদের বসবাস ছিল। এখানে এক একটি বিহারী কলোনী ছিল এক একটা মিনি ক্যান্টনমেন্ট। রাজবাড়ী যুদ্ধ হয়েছিল মুলত বিহারীদের সাথে।
সারাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় এ হত্যাকাণ্ড চলে। রাজবাড়ীর বধ্যভূমিগুলোতে অসংখ্য মাথার খুলি, হাড়গোড় ও চুল পাওয়া গেছে। চিহ্নিত করা গেছে বেশ কিছু স্থান।
রাজবাড়ীর কিছু কিছু স্থান সংরক্ষণ করা হলেও অবহেলা আর অযত্নে রয়ে গেছে বহু স্থান। শুধু ১৪ই ডিসেম্বর নয় পুরো নয় মাস ধরেই চলে এই হত্যাকান্ড।
রাজবাড়ীতে অবাঙ্গালীরা এতই শক্তিধর ছিল যে সমস্ত দেশ ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হলেও রাজবাড়ী শত্রু মুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর।
তথ্য এবং স্মৃতি চিহ্ন সংরক্ষণে এখনই উদ্যোগ নেয়া উচিত। স্বাধীনতার যেহেতু ৫০ বছর হয়ে গেছে তাই আরো দেরি হলে হয়তো সংরক্ষণের জন্য উপাদান পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এসব শুধু গল্পই হয়ে যাবে। রাজবাড়ী জেলার এরকম কিছু স্থানের বিষয় এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো।
কালুখালী রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশের বধ্যভূমি
কালুখালী রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশের বধ্যভূমিতে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। এই সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট (অব.) আকামত আলী মণ্ডল বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় কালুখালী রেলস্টেশনের ওই স্থানে একটি বড় খাল ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা নিরীহ মানুষকে হত্যা করে ওই খালে ফেলত।
কালুখালীর মালিয়াট বধ্যভূমি
কালুখালীর মালিয়াট বধ্যভূমিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিভিন্ন স্থান থেকে নিরীহ মানুষকে ধরে এনে সেখানে ফেলে রাখত।
লোকোশেড বধ্যভূমি
রাজবাড়ীর লোকোশেড এলাকা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প। শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে হত্যা করে লোকোশেডের পুকুরে ফেলে দেওয়া হতো। তখন রাজবাড়ী রেলস্টেশন দিয়ে বেশ কয়েকটি ট্রেন চলাচল করত। ট্রেন রাজবাড়ী রেলস্টেশনে থামলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা বগিতে থাকা যাত্রীদের সন্দেহ হলে ধরে লোকোশেড ক্যাম্পে নিয়ে আসত। তারপর নির্যাতন করে হত্যার পর পুকুরে ফেলে দিত।
গোয়ালন্দের গণহত্যা
১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল সকাল নয়টার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে গোয়ালন্দের উজানচরের বাহাদুরপুর ঘাটে আসে। এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও সম্মিলিত জনতা তাদের বাধা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ হন আনছার কমান্ডার ফকির মহিউদ্দিন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঘাট দখল করে অদূরে বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে প্রবেশ করে গ্রামের ২১ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর অবাঙালি বিহারি ও রাজাকাররা ব্যাপক লুটপাটের পর গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয়।
ছোটভাকলার বালিয়াকান্দি গ্রামে গণহত্যা
ছোটভাকলার বালিয়াকান্দি গ্রামে ২৭ এপ্রিল কুখ্যাত বিহারি সাইদ, ইউনুছ, সামিমসহ ১৫ থেকে ২০ জনের সশস্ত্র একটি দল স্থানীয় জমিদার যামিনী রঞ্জন রায়ের বাড়িতে হামলা চালিয়ে জমিদারের শ্যালক হরেকৃষ্ণ, পার্শ্ববর্তী জমিদার মুহিত কুমার সাহার ছেলে মৃগেন্দ্র নাথ সাহা, জমিদারবাড়িতে আশ্রয় নেওয়া স্কুলপণ্ডিত পরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী ও পণ্ডিতের ভায়রাকে (অজ্ঞাত) গুলি করে হত্যা করে। এরপর বিহারিরা জমিদারবাড়িতে ব্যাপক লুটপাট চালায়। বিহারিরা চলে যাওয়ার পর রাত ১০টার দিকে স্থানীয় স্কুলশিক্ষক আবদুল আজিজ শিকদার ও অনীল চন্দ্র বৈরাগী লাশ চারটিকে জমিদার বাড়ির পেছনে গর্ত করে পুঁতে রাখেন।
পাংশার তারাপুর ব্রিজ বধ্যভূমি
১৯৭১ সালের ২১ মে পাংশার বাবুপাড়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর বাহিনী এলাকার নিরীহ ৩৬ জনকে হত্যা করে রেলব্রিজের নিচে পুঁতে রাখে।
পাংশার বধ্যভূমি সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা চাঁদ আলী খান জানান, সেদিন ছিল ২১ মে। পাকিস্তান বাহিনী রেলগাড়িতে করে এসে নামে মাচপাড়া রেলস্টেশনে। এরপর পশ্চিম পাশে মথুরাপুর, কালিনগর ও রামকোল বাহাদুরপুর গ্রামে ঢুকে বাড়িঘর জ্বালিয়ে–পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। এদের সঙ্গে মিলিশিয়া, বিহারি, রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকেরাও যোগ দেয়। গ্রামগুলো থেকে ৩৬ জন নিরীহ মানুষকে ধরে বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে তারাপুর রেলব্রিজের কাছে নিয়ে আসে। তাদের মধ্যে তখনো কেউ কেউ বেঁচে ছিলেন। তখন ছিল বর্ষাকাল। ব্রিজের নিচ দিয়ে স্রোত বইছিল। নরপশুরা ওই ৩৬ জনের সবাইকে ব্রিজের নিচে ফেলে দিয়ে হত্যা করে।
এছাড়া মাচপাড়া রেলস্টেশনের কাছে ইন্দারার মধ্যেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী মানুষকে হত্যা করে ফেলে দেয়, যাদের একজন ইউনিয়ন পরিষদের সচিব হরেন্দ্রনাথ সরকার। তাঁকে হত্যা করে ইন্দারার মধ্যে ফেলা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের মাটিতে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়, তা ছিল বিশ শতাব্দীর অন্যতম নৃশংস গণহত্যা। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে ৮ মাস ২ সপ্তাহ ৩ দিনের এই গণহত্যার স্বরূপ ছিল ভয়ঙ্কর। পরিকল্পিত পন্থায় বাঙালিকে খুন করা হয়েছে, গণহারে নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে; ঘরবাড়িতে আগুন দেয়াসহ অপহরণ, গুম ও বর্বর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে এসব বর্বরতায় সহযোগী ছিল বাঙালি ও অবাঙালি সদস্য সমন্বয়ে গঠিত রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং শান্তি কমিটির সদস্যরা।
কোলার হাটে সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় নেয়া একটি বাড়ীকে স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে সরকারী উদ্যোগে সংরক্ষনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
রামকান্তপুর অস্থায়ী হাসপাতাল হিসাবে পরিচিত যেখানে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেয়া হত। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করা জায়গাটি সংরক্ষন করা দরকার ।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.