May 30, 2025, 10:23 am


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2025-05-29 09:46:08 BdST

ভুয়া পরিচয়ে এক যুগ ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি


‘স্যার, আমি জাহালম। আমি আবু সালেক না…আমি নির্দোষ।’ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এর বিচারকের উদ্দেশে তাঁকে বারবার বলতে দেখা যায়, ‘আমি আবু সালেক না।’

পরে জানা যায়, আবু সালেকের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের পরিবর্তে জেল খাটেন জাহালম, আদালতে হাজিরাও দেন তিনি।

জাহালম ছিলেন পেশায় পাটকলশ্রমিক। পরে মুক্তি পান জাহালম, এজন্য পরবর্তীতে তিনি ক্ষতিপূরণও পান। ২০১৭ সালে ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর তখন দেশজুড়ে বেশ আলোচনা তৈরি হয়।

একই রকম ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। তবে সেটি এক আসামির পরিবর্তে অন্যজনের জেল খাটার ঘটনা নয়। এবারের ঘটনাটি একজনের পরিবর্তে আরেকজনের চাকরি করে যাওয়ার, তাও প্রায় এক যুগ ধরে। ছবি পরিবর্তন করে এক যুগ ধরে একজনের পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করেছেন আরেক ব্যক্তি। অবশেষে তদন্তে ধরার পর সম্প্রতি সেই নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।

বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি হয় মো: আব্দুল ওয়ারেছ আনসারীর। তবে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ না দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক।

নিয়োগ পেয়েও মো: আব্দুল ওয়ারেছ আনসারী বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ না দেওয়ায় সেই সুযোগটিকে কাজে লাগান বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা মো: শাহজাহান মিঞা। আব্দুল ওয়ারেছ আনসারীর জায়গায় তিনি নিজের ভাগ্নেকে নিয়োগ দেন। এজন্য ভাগ্নের নাম পরিবর্তন করে মো: আব্দুল ওয়ারেছ আনসারী রাখা হয়। আবদুল ওয়ারেছ আনসারী নামে শাহজাহান মিঞার ভাগ্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাকরি করেন ১২ বছর। দীর্ঘ এই চাকুরীজীবনে দুটি পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন যুগ্ম পরিচালক।

তদন্তে দেখা যায়, প্রতারক আনসারীর এই কাজে সহযোগিতা করেছেন তার মামা ও তৎকালীন নিয়োগ শাখার উপপরিচালক মো. শাহজাহান মিয়া, যিনি পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক অভ্যন্তরীণ তদন্তে এই অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসার পর মো: শাহজাহান মিঞাকে বরখাস্ত ও তাঁর ভাগ্নের নিয়োগ বাতিল করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, অভ্যন্তরীণ তদন্তে বিষয়টি বেরিয়ে এলে গতকাল বুধবার প্রতারক ওয়ারেশ আনসারীকে স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই প্রতারক পদোন্নতি পেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রাজশাহী অফিসে যুগ্ম পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

একই সঙ্গে এই প্রতারণায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করার অপরাধে অতিরিক্ত পরিচালক মো. শাহজাহান মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তদন্তে তার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে স্থায়ী বহিষ্কারাদেশসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি নজরে আসায় তাঁর নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। আর কেউ এমন সুযোগ নিয়েছেন কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, মো: শাহজাহান মিঞার সহযোগিতায় ভুয়া নাম, পরিচয় ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরিতে যোগ দেন তাঁর ভাগ্নে। এজন্য নিয়োগের সময় সুকৌশলে প্রার্থীর ছবিও বদল করা হয়। সেই সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবিও পরিবর্তন করা হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, গত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে বাংলাদেশ ব্যাংকে নিয়োগে ও কর্মকর্তাদের বয়স পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তবে ব্যবস্থা নেওয়া হয় খুবই কম।

এদিকে বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী প্রকৃত আব্দুল ওরায়েছ আনসারী গণমাধ্যমকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ২৮ মে তাকে বিষয়টি জানালে তিনিই প্রথম জানতে পারেন যে, তার নাম-পরিচয় ব্যবহার করে দীর্ঘদিন কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন।

এডিসি আনসারী জানান, তিনি ২০১৩ সালে ৩১তম বিসিএস ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক (সাধারণ) পদে উভয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, তবে তিনি প্রশাসন ক্যাডার বেছে নেন।

তিনি বলেন, ‘আমি কখনো বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করিনি। জানতামই না যে কেউ আমার পরিচয় ব্যবহার করে চাকরি করছে। আজ (বুধবার) আমি জানতে পারি। মূলত আমি একইসঙ্গে দুটি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু বিসিএসে আগে যোগদান করি। পরে আমি কুড়িগ্রামে কর্মরত অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগপত্র আসে। এজন্য আর যোগদান করা হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সম্ভবত ২০১৩ সালের মার্চের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের যোগদানপত্র পেয়েছিলাম। আমি যোগদান না করায় তারা এই প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জানতে পারলাম, তারা আমার যোগদানপত্র, এমনকি আমি যে খাতায় পরীক্ষা দিয়েছি, সেটাই ব্যবহার করেছে। এটি একটি বড় ধরনের প্রতারণা। এটা ধরতে এত বছর লেগেছে দেখেই আমি আশ্চর্য।’

তিনি বলেন, কিছুদিন আগে আমার কয়েকজন বন্ধু জানায়, আমার নাম ও পরিচয় ব্যবহার করে একজন বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করছেন। এরপর শুনতে পেরেছি তাঁর নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আইবাস ব্যবহার করে আমাদের (সরকারি চাকরিজীবী) বেতন হয়, যেখানে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বেতনও এই ব্যবস্থার মাধ্যমে হলে বিষয়টি আরও আগেই ধরা পড়ত।’

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, শাহজাহান মিয়াই এই প্রতারণার মূল হোতা। ঐ সময় তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ শাখায় কর্মরত ছিলেন। তারা দুজন আত্মীয়ও বটে। প্রাথমিক তদন্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উক্ত নিয়োগে অনিয়ম-সংক্রান্ত অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হওয়ায় প্রধান অভিযুক্ত মো: শাহজাহান মিঞাকে গতকাল সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। প্রতারক আনসারী ২৭ মে পর্যন্ত চাকরিতে ছিলেন। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে চাকরিচ্যুত করে।

এই বিষয়ে কথা বলতে প্রতারক আনসারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। শাহজাহান মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.