December 30, 2025, 6:05 pm


রেজাউল করিম চৌধুরী

Published:
2025-12-30 16:07:13 BdST

প্রস্তাবিত ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের বিরোধিতার ছয়টি কারণ


প্রস্তাবিত ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের বিরোধিতার ছয়টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এই কারনগুলো নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হচ্ছে এই প্রতিবেদনে।

(১) ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক (MCB) প্রতিষ্ঠায় তাড়াহুড়ো না করে অংশীজনদের ব্যাপক মতামতের প্রয়োজন

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গত ১৫ই ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক গঠনের খসড়া অধ্যাদেশ ঘোষণা করেছে এবং জনমতের জন্য ১৫ই জানুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত সময় দিয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে এমআরএ (MRA)-এর অধীনে প্রায় ৭০০টি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান (MFI) পরিচালিত হচ্ছে। যদিও বড় এমএফআইগুলো বাজারের বড় অংশ দখল করে আছে, তবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মূলত ছোট ও মাঝারি এমএফআইগুলো কাজ করে। তারা শুধু ঋণই দেয় না, বরং টেকসইভাবে স্বাস্থ্য, দুর্যোগ মোকাবিলা এবং শিক্ষার মতো 'প্লাস' কার্যক্রম পরিচালনা করে। তারা সমন্বিত বা 'হোলিস্টিক' পদ্ধতিতে কাজ করার জন্য দেশ-বিদেশ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে, যা এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর নিয়ন্ত্রণে থাকে। এমআরএ-ও সামাজিক উন্নয়নে উদ্বৃত্তের ২০% পর্যন্ত ব্যয়ের অনুমতি দেয়।

এই প্রেক্ষাপটে এত দ্রুত ব্যাংক গঠন প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ।

(২) ছোট ও মাঝারি এমএফআই-সহ সবার মতামত নেওয়া কেন জরুরি:

ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো যদি তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে ব্যাংকে রূপান্তরিত হয়, তবে তারা তাদের 'সমন্বিত ও সামগ্রিক' সামাজিক কার্যক্রম কীভাবে চালিয়ে যাবে—তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের মূল ভিত্তিই ছিল সমন্বিত উন্নয়ন। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংকে রূপান্তর করা মূলত একটি 'মিশন ড্রিফট' বা লক্ষ্যচ্যুতি।

বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শুধু আয়ের ভিত্তিতে দারিদ্র্য পরিমাপ না করে মানুষের ঝুঁকি ও নাজুক অবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

(৩) ২০২৬ পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের প্রভাব কী হবে:

এই খাতে প্রায় ৪ কোটি পরিবার জড়িত এবং ৫ লক্ষ কর্মী কাজ করছেন। মোট ১৩ বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে সদস্যদের সঞ্চয় ৫ বিলিয়ন ডলার (৪৩%)। পিকেএসএফ (PKSF) ৭ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকেরও ১৮ শতাংশ এখানে অংশীদারিত্ব রয়েছে।

২০২৬ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে বৈদেশিক অনুদান আরও কমে যাবে। গত দুই দশকে এই খাতে বৈদেশিক অনুদান প্রায় নেই বললেই চলে।

এমএফআইগুলো উদ্যোক্তা তৈরি এবং কারিগরি শিক্ষা দিয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলছে। ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের উদ্যোগ এই প্রগতিশীল ভূমিকা হ্রাস করতে পারে, যা মূলত ক্ষুদ্রঋণের উদ্বৃত্তের ওপর নির্ভরশীল।

(৪) ক্ষুদ্রঋণ খাতের অগ্রাধিকার এবং প্রস্তাবিত ব্যাংকের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই:

এই খাতের প্রকৃত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা প্রয়োজন। একজন কর্মী হিসেবে আমি মনে করি বর্তমান সমস্যাগুলো হলো:

ক. ঋণের দ্বৈততা এবং ওভারল্যাপিং।

খ. কর্মীদের দ্বারা অর্থ আত্মসাৎ।

গ. খেলাপি ঋণের প্রবণতা বৃদ্ধি।

ঘ. ছোট ও মাঝারি এমএফআই-এর জন্য ভর্তুকিযুক্ত মূলধনের অভাব।

ঙ. আরজেএসসি (RJSC) নিবন্ধনে জটিলতা ও অস্বাভাবিক বিলম্ব।

এমআরএ (MRA) কর্তৃক প্রস্তাবিত সিআইবি (CIB) এবং এসআইবি (SIB) সফটওয়্যারের কাজ ধীরগতিতে চলছে। অন্যদিকে, পিকেএসএফ-এর মূলধন সীমাবদ্ধতা এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদ ও কঠিন শর্ত ক্ষুদ্রঋণ খাতের জন্য সহায়ক নয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি এই খাতকে সাহায্য করতে চায়, তবে এই পাঁচটি সমস্যার সমাধান করা উচিত। ব্যাংক গঠন করলে এই সমস্যাগুলো সমাধান হবে না, বরং ছোট এনজিওগুলো বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

(৫) ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক ছোট ও মাঝারি এমএফআই-এর জন্য অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করবে:

খসড়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী, প্রস্তাবিত ব্যাংকগুলোকে এমন কিছু 'সুপার পাওয়ার' বা বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে যা এমএফআই-এর নেই:

ক. এই ব্যাংক 'পাবলিক ডিমান্ড রিকভারি অ্যাক্ট ১৯৩১' অনুযায়ী ঋণ আদায়ের জন্য সার্টিফিকেট মামলা করতে পারবে, যা সাধারণ এমএফআই পারে না।

খ. ব্যাংক স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক বা হাইপোথিকেশন নিতে পারবে।

গ. বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ ও বিনিয়োগ করতে পারবে, যা এমএফআই-এর জন্য সীমাবদ্ধ।

ঘ. ব্যাংকের লাইসেন্স বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিতে হয়, ফলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এমআরএ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে আইনি জটিলতা ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে।

ঙ. এমএফআই-এর বিকাশে নিবেদিতপ্রাণ নেতৃত্বের ভূমিকা অপরিসীম (যেমন: ফজলে হাসান আবেদ বা শফিকুল হক চৌধুরী)। শুধুমাত্র যান্ত্রিক গণতান্ত্রিক নিয়ম চাপিয়ে দিলে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

(৬) ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক গঠনের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ইতিবাচক নয়:

যেসব দেশে ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক (MF Bank) তৈরি করা হয়েছে, সেখানে দেখা গেছে যে এটি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রান্তিক করে ফেলেছে। অনেক দেশে প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ছোট ও মাঝারি এমএফআইগুলো ধসে পড়েছে।

তাই আমাদের অত্যন্ত সতর্কতার সাথে এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা উচিত।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.